article

সমকালীন বিশ্বে ইসলাম প্রচারের কৌশল

২৪ আগস্ট, ২০২২, রাত ১২:০০

শায়খ আহমাদুল্লাহ

শেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ সকল নবীকে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন দীনের প্রচার ও প্রসারের জন্য। তাঁরা আমৃত্যু নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সেই গুরুদায়িত্ব যথাযথভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন। বিদায় হজের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (সা.) সমবেত সাহাবাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি কি (দীনের দাওয়াহ) পৌঁছিয়েছি?’ সাহাবাগণ প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘হ্যাঁ, আপনি যথাযথভাবে পৌঁছিয়েছেন।’ এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) তর্জনি আসমানের দিকে উঁচু করে বললেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি সাক্ষী থাকুন।’ অতঃপর তিনি সমবেতদের উদ্দেশে বলেন, ‘উপস্থিতরা যেন অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছে দেয়। কেননা, যাদের কাছে পৌঁছানো হবে তাদের মধ্যে অনেক ব্যক্তি এমন থাকে, যারা শ্রবণকারীর চেয়ে অধিক সংরক্ষণকারী।’[i]

তখন থেকে এখন পর্যন্ত দাওয়াহর ধারা চলমান আছে, কিয়ামত অবধি চলমান থাকবে ইন-শা-আল্লাহ। প্রত্যেক যুগের দা‘য়ীরা সে যুগের ভাষা, ভঙ্গি, কৌশল, পদ্ধতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে দাওয়াহর কাজ করেছেন। এটাই দাওয়াহর নিয়ম। এভাবেই ইসলাম আরব ভূখণ্ড থেকে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ইসলামের আলোয় আলোকিত করে চলেছে জনপদের পর জনপদ। কিয়ামতের আগে এভাবেই ইসলাম প্রতিটি জনপদে পৌঁছে যাবে। এভাবেই হাদীসের ভাষ্যানুসারে কিয়ামতের আগে প্রতিটি পাকা ও কাঁচা ঘরে পৌঁছে যাবে।[ii]

সময়ের ভাষা আয়ত্ব করে আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে দাওয়াহর কাজ করলে এ যুগেও ইসলামের দাওয়াহ ফলপ্রসূ হবে ইন-শা-আল্লাহ। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি বিবেচনায় দাওয়াহর মাধ্যম, পদ্ধতি ও কৌশল কী হতে পারে, এটাই বক্ষমান নিবন্ধের প্রতিপাদ্য।

এটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। তথ্যপ্রযুক্তি পৃথিবীকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে, মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করে দিয়েছে; এর মাধ্যমে মানবজীবনে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এটি অনিবার্য এক বাস্তবতা। এই বাস্তবতা স্বীকার করে এর সফল ও কার্যকর ব্যবহার করে দাওয়াহর কাজ করলে অনেক সফলতা আসবে ইন-শা-আল্লাহ। এটিকে অস্বীকার করলে অথবা অবজ্ঞা করলে দাওয়াতি কাজ অনেকখানিই পিছিয়ে যাবে।
বস্তুত দুনিয়ার নবআবিষ্কৃত সব প্রযুক্তিই আল্লাহর সৃষ্টি থেকে সৃষ্ট। কারণ মৌলিক পদার্থ সব আল্লাহর দান। আল্লাহ-সৃষ্ট পদার্থসমূহের পারস্পরিক সংযোগের মাধ্যমে মানুষ নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করে। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীতে অবস্থিত সবকিছু।’[iii]

যে জাতি যত বেশি শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শী, সে জাতি তত বেশি বৈষয়িকভাবে উন্নত। ইসলাম মানুষের জন্য যে কোনো কল্যাণকর প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার অনুমোদন করে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি যখন আয়াত নাযিল হয় ‘আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের ভীতি প্রদর্শন করুন’[iv], তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করে বিভিন্ন গোত্রের নাম ধরে ধরে তাদেরকে ঈমানের দাওয়াহ দেন এবং কুফরের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেন।[v] পহাড়ের উপর আরোহণের কারণ, এতে আওয়াজ বেশি দূর পর্যন্ত পৌঁছায়। এ থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, দাওয়াহ বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য বৈধ মাধ্যম গ্রহণ করা অনুমোদিত, বরং সুন্নাতে নববী দ্বারা নির্দেশিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) সাধ্যমত সে যুগের মাধ্যম ব্যবহার করেছেন। এখন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। এ যুগে দাওয়াহর কাজে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সুন্নাহ বলে বিবেচিত হবে।

তবে প্রযুক্তির প্রায় প্রতিটি জিনিসের একাধিক রকম ব্যবহার সম্ভব। ভালো-খারাপ দুই ক্ষেত্রেই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়। প্রযুক্তির এরকম দ্বিবিধ ব্যবহার সবসময়ই হয়ে আসছে। আমরা যারা দাওয়াতি কাজে নিরত আছি, তারা এর ইতিবাচক কল্যাণকর ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেকে এবং উম্মাহকে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করতে পারি; বরং তা-ই করা উচিত। কেননা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কম সময়ে বেশি মানুষের কাছে দাওয়াহ পৌঁছানো সম্ভব।
মৌলিকভাবে প্রযুক্তি নিরীহ ও নিরপেক্ষ। ব্যবহারকারী একে ভালো পথে অথবা খারাপ পথে চালিত করে। খারাপ মানুষের হাতে ব্যবহৃত হয়ে প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণ সাধন করে। পক্ষান্তরে খারাপ মানুষের হাতে ব্যবহৃত হয়ে মানুষের ক্ষতি করে।

ফেইসবুক: আধুনিক যোগাযোগের অন্যতম একটি মাধ্যম। এটি তরুণ প্রজন্মের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। এর ক্ষতিকর অনেক দিক থাকলেও দা‘য়ীরা একে দাওয়াহর মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। ফেইসবুকের ক্ষতিকর কিছু দিক বিবেচনা করে দা‘য়ীরা একে পুরোপুরি বর্জন করলে যারা এর মাধ্যমে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন, তারা মুক্তির পথ পাবেন না। ইন্না মিনাল বায়ানি লাসিহরান—কিছু বর্ণনায় আছে যাদু। আপনার একটি স্ট্যাটাস বা একটি দাওয়াতি কন্টেন্ট কারো না কারো মনে ইতিবাচকভাবে রেখাপাত করতে পারে।

তবে এক্ষেত্রে তাদেরই কাজ করা উচিত, নিজেকে যারা এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দূরে রাখতে পারবেন। যিনি নিজেকেই এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দূরে রাখতে পারেন না, তাকে এই মাধ্যমে দাওয়াতি কাজের পরামর্শ আমরা দেব না। আত্মরক্ষার পরে জাতিকে রক্ষার চেষ্টা করতে হবে। নিজেকে রক্ষা করতে না পারলে জাতিকে রক্ষা করা যাবে না।

ইউটিউব: এই শতাব্দীর অন্যতম একটি যোগাযোগ-প্রযুক্তি হলো ইউটিউব। এটি ভিডিও কন্টেন্ট প্রচারের একটি মাধ্যম। এই মাধ্যমটি ব্যবহার করে আমরা কুরআন-সুন্নাহর বাণী, ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান, সমসাময়িক ইস্যুতে ইসলামের নির্দেশনা মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারি।

দুঃখজনকভাবে এ যুগে মানুষের পড়ার অভ্যাস অনেকখানি কমে গেছে। বই পড়া অনেকটা আয়াসসাধ্য ব্যাপার। যে বিষয়টা জানার জন্য একশ’ পৃষ্ঠার একটা বই পড়তে হয়, তার সারমর্ম যদি দশ মিনিটের একটা ভিডিওতে পাওয়া যায়, মানুষ দশ মিনিটের ভিডিওটাই দেখে নিতে পছন্দ করে। বই পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়া যদিও মৌলিকভাবে ভালো নয়, তবে এই অভ্যাসটা ব্যবহার করে দা‘য়ীরা দাওয়াহর কাজ করতে পারেন। কুরআন-সুন্নাহর বাণী ভিডিও আকারে ছড়িয়ে দিতে পারেন। কে জানে, কোন্ কথাটা কার মনে রেখাপাত করবে!

টেলিভিশন: টেলিভিশন মূলত পারিবারিক বিনোদনমাধ্যম। কতটুকু বাস্তবসম্মত জানি না, তবে দাবি করা হয় টেলিভিশনে পারিবারের সবার সঙ্গে একত্রে দেখার মতো অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। বাস্তব হোক বা অবাস্তব, এটা তো সত্য যে টেলিভিশনটা এখনো অধিকাংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণির ঘরের শোভা বর্ধন করে। কাজেই একে হেলাফেলা করার তেমন সুযোগ নেই। যাদের সুযোগ আছে, তারা এই মাধ্যমেও দাওয়াতি কাজ করেত পারেন। ইসলামের পরিবারব্যস্থা, সন্তান লালন-পলনের ইসলামী পদ্ধতি, আদব-আখলাক, পিতা-মাতার হক, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক হক, প্রতিবেশীর হক, ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন—এসব আলোচনা নিয়মিত করেলে আমার ধারণা অনেক মানুষ ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ করবে।

এখনো অনেক মানুষ মনে করে, ইসলাম শুধু ব্যক্তিগত পরিসরে সালাত-সিয়ামের মতো কিছু আনুষ্ঠানিকতার নাম। পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে ইসলামের নির্দেশনা কী, এসব আলোচনা করলে অনেকেই ইসলামের সঠিক রূপরেখা সম্পর্কে জানতে পারবে।

রেডিও: বালাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে গেলে রেডিও বিলুপ্তির পথে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখনো এফএম রেডিও যথেষ্ট দাপটের সঙ্গে সচল আছে। সেসব দেশের মানুষ গাড়িতে বসেই কানে ইয়ারফোন গুজে রেডিও শুনতে থাকে। এসব অঞ্চলে যারা দাওয়াতি কাজ করেন, তারা রেডিওকেও ইসলাম প্রচারের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন।

প্রিন্ট মিডিয়া: ইন্টারনেটের যুগে প্রিন্ট মিডিয়ার কদর অনেকখানি কমলেও এখনো অনেক মানুষ সকালের নাশতার টেবিলে বসে পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে নিতে পছন্দ করে। পত্রপত্রিকার প্রভাব অনেকাংশ খর্ব হওয়া সত্ত্বেও এই মাধ্যমটার ব্যবহার এখনো কম নয়। বিপুল সংখ্যক মানুষ পত্রিকার প্রিন্ট এবং ওয়েব ভার্সনে চোখ রাখে সমসাময়িক কলাম পড়ার জন্য। যেসব দা‘য়ীর লেখার হাত ভালো, অন্তত যারা চলনসই লেখালেখি করতে পারেন, তারা এই ব্যাপারটিকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করতে পারেন। প্রিন্ট মিডিয়ায় দাওয়াতি কাজ করার মাধ্যমে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারেন।

ওয়েব পত্রিকা: এটি সমকালীন বিশ্বে দাওয়াহর অন্যতম মাধ্যম হতে পারে। ধীরে ধীরে এটি প্রিন্ট মিডিয়ার স্থান দখল করে নিচ্ছে। বিপুল সংখ্যক মানুষ এখন টাকা খরচ করে পত্রিকা কেনার চেয়ে মোবাইলের মাধ্যমে ওয়েব পত্রিকায় ঢু মারা বেশি পছন্দ করে। কাজেই দাওয়াতি কাজের জন্য ওয়েব পত্রিকা তৈরি করা এবং আগে থেকে তৈরিকৃত ওয়েব পত্রিকায় লেখালেখি করে বিপুল সংখ্যক মানুষের দীনি বিষয়ে অনুসন্ধিৎসার ক্ষুধা নিবরণে ভূমিকা রাখা যেতে পারে। দুঃখজনকভাবে ইসলামী বিষয়কে উপজীব্য করে বানানো ওয়েব পত্রিকা একেবারেই অপ্রতুল। এ ব্যাপারে পাদর্শীদের এগিয়ে আসা উচিত।

মেইল ও টেক্সট মেসেজ: প্রিয়নবী (সা.) চিঠিপত্রের মাধ্যমেও দাওয়াতি কাজ করেছেন। সেই হিসেবে চিঠিপত্রের মাধ্যমে দাওয়াতি কাজ করাও সুন্নাহ। মেইল ও টেক্সট মেসেজ চিঠিপত্রেরই আধুনিক সংস্করণ। পরিচিত বা অপরিচিত একজন একটা গর্হিত কাজ করছে, তাকে হিকমাহর সঙ্গে বারণ করা দা‘য়ীর দায়িত্ব, এটি নাহী আনিল মুনকারের অন্তর্ভুক্ত। নানা কারণে সামনাসামনি সেটি আমরা হয়ত বলতে পারি না। হয়ত উদ্দিষ্ট ব্যক্তি আমার কাছ থেকে অনেক দূরে। সেক্ষেত্রে আমি যদি তাকে ইমেইল বা টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে বিষয়টা সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে বিনীতভাবে সতর্ক করি, তাহলে এর মাধ্যমে দাওয়াহ পৌঁছানোর দায়িত্ব পালিত হবে ইন-শা-আল্লাহ। এর মাধ্যমে চিঠিপত্রের মাধ্যমে দাওয়াহ প্রদানের সুন্নাহও আদায় হয়ে যাবে।

এখানে আমরা সমকালীন বিশ্বে ইসলাম প্রচারের কয়েকটা মাধ্যম সম্পর্কে আলোচনা করলাম। এগুলো উদাহরণ মাত্র। এছাড়া যত মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করা সম্ভব ও উপযোগী, সেই সব মাধ্যমে ব্যবহার করে যথাযথ পদ্ধতিতে ইসলাম প্রচার করা যেতে পারে। তবে প্রত্যেক দা‘য়ী সবগুলো মাধ্যমে দাওয়াহর কাজ করতে সক্ষম নন। যিনি যে পদ্ধতি ও মাধ্যমে সক্ষম, সচ্ছন্দ ও পারদর্শী— তিনি সে পদ্ধতি ও মাধ্যমে কাজ করবেন।
উপরে আমরা দীন প্রচারের কৌশল ও প্রচারমাধ্যম সম্পর্কে যৎসামান্য আলোকপাত করেছি। তবে প্রচারমাধ্যম যা-ই হোক, মৌলিকভাবে দাওয়াতি কাজের কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক উসূল ও মূলনীতি জানতে হবে এবং তদনুযায়ী আমল করতে হবে। দা‘য়ীর মধ্যে যেসব গুণাবলি থাকা দরকার, তা নিজের মধ্যে ধারণ করতে হবে। তবেই দাওয়াহ ফলপ্রসূ হবে এবং উম্মাহর প্রভূত কল্যাণ সাধিত হবে। কলেবর বৃদ্ধির কারণে আমরা এই নিবন্ধে দাওয়াহর মূলনীতি ও দা‘য়ীর গুণাবলি সম্পর্কে আলোচনা করিনি। সময়-সুযোগ হলে অন্য নিবন্ধে সে সম্পর্ক আলোচনা করা হবে ইন-শা-আল্লাহ।


তথ্যসূত্র
[i] সহীহ বুখারী-১৭৪১
[ii] মুসনাদে আহমাদ-২৩৮১৪
[iii] সূরা বাকারা-২৯
[iv] সূরা শূয়ারা-২১৪
[v] সহীহ বুখারী-৪৭৭০