article

ঝড়-বৃষ্টির সময়ে পালনীয় দশটি সুন্নাহ

৩০ মে, ২০২৪, রাত ১২:০০

শায়খ আহমাদুল্লাহ

বৃষ্টি মহান আল্লাহর নেয়ামত। এ নেয়ামতে শুধু মানুষ নয়, পশুপাখি এমনকি গাছ-গাছালি সিক্ত হয়। যখন প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, তখন একটুখানি বৃষ্টির পরশ পাওয়ার জন্য আমরা অস্থির হয়ে উঠি। বৃষ্টির ফলে আমাদের দেহমন শীতল হয়। সজীব হয় ফসলের মাঠ ও আমাদের প্রিয় বসুন্ধরা। সব প্রাণবিশিষ্ট বস্তু পানি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেন-

وَ جَعَلۡنَا مِنَ الۡمَآءِ کُلَّ شَیۡءٍ حَیٍّ

অর্থ : আর আমি সকল প্রাণবান জিনিসকে পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। [সুরা আল-আম্বিয়া : ৩০]

বৃষ্টি মহান আল্লাহর অনুগ্রহ। তিনি অনুগ্রহ করে আমাদেরকে বৃষ্টি দান করেন। অন্যথায় আকাশ থেকে বৃষ্টি নামানোর সাধ্য আমাদের ছিল না। আল্লাহ তাআলা বলেন,

اَفَرَءَیۡتُمُ الۡمَآءَ الَّذِیۡ تَشۡرَبُوۡنَ ﴿ؕ۶۸﴾ ءَاَنۡتُمۡ اَنۡزَلۡتُمُوۡهُ مِنَ الۡمُزۡنِ اَمۡ نَحۡنُ الۡمُنۡزِلُوۡنَ ﴿۶۹﴾

অর্থ : যে পানি তোমরা পান করো, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তা কি তোমরাই মেঘ থেকে বর্ষণ করো, নাকি আমিই তা বষর্ণ করি? [সুরা ওয়াকিয়া : ৬৮-৬৯]

আমরা যখন বৃষ্টির অভাবে হতাশ হয়ে পড়ি, তখন আল্লাহ তাআলা বৃষ্টি দান করে আমাদের জীবনকে রহমত দ্বারা ভরে দেন। কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে,

وَ هُوَ الَّذِیۡ یُنَزِّلُ الۡغَیۡثَ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا قَنَطُوۡا وَ یَنۡشُرُ رَحۡمَتَهٗ ؕ وَ هُوَ الۡوَلِیُّ الۡحَمِیۡدُ.

অর্থ : আর তারা হতাশ হয়ে পড়লে তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তাঁর রহমত ছড়িয়ে দেন। আর তিনিই প্রশংসার্হ অভিভাবক। [সুরা শুরা : ২৮]

মোটকথা বৃষ্টি আমাদের জন্য অনেক বড় নেয়ামত। তাই বৃষ্টি বর্ষিত হলে আমাদের উচিত মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতায় সমর্পিত হওয়া। বৃষ্টি কখনো কখনো আমাদের জন্য ক্ষতিকরও হতে পারে। বিশেষ করে যখন বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ো বাতাস বয়ে থাকে। ঝড়-বৃষ্টির সময়ে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিছু সুন্নাহও রয়েছে। সেই সুন্নাহগুলোও পালন করা উচিত। ঝড়-বৃষ্টির সময় পালনীয় সুন্নাহগুলো নিম্নরূপ—

. ঝড়-বৃষ্টির ক্ষতি থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা

বৃষ্টির সময় কখনো কখনো প্রবল বাতাস প্রবাহিত হয়। এ কারণে বৃষ্টির সময় প্রবাহিত হওয়া ঝোড়ো বাতাস ও এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। যে কোন দূর্যোগ-দুর্বিপাকে সাধ্য অনুযায়ী সতর্ক থাকা ইসলামের নির্দেশ। নিজের সামর্থ অনুযায়ী সতর্ক থাকার পাশাপাশি একজন ঈমানদার আল্লাহর আশ্রয় কামনা করবে। কারণ, আল্লাহর নিয়ন্ত্রণেই সব কিছু।     

২. বৃষ্টির দোয়া পাঠ করা

বৃষ্টির বিশেষ দোয়া আছে। যখন বৃষ্টি নামে তখন দোয়াটি পড়া সুন্নাহ। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দিকা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বৃষ্টি দেখতেন, তখন এ দোয়া পড়তেন—

اللَّهُمَّ صَيِّبًا نَافِعًا

অর্থ : হে আল্লাহ এ বৃষ্টিকে উপকারী বৃষ্টি বানান। [সহিহ বুখারি, ৯৮৫; মুসনাদে আহমাদ, ২৪১৪৪]

৩. অতিবৃষ্টি দেখা দিলে বিশেষ দোয়া পাঠ করা

যখন অতিবৃষ্টি দেখা দেয় এবং ফল-ফসল, জনপদ ইত্যাদির ক্ষতি হয়, তখন নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করা সুন্নাহ—

اللَّهُمَّ حَوَالَيْنَا وَلاَ عَلَيْنَا، اللَّهُمَّ عَلَى الآكَامِ وَالْجِبَالِ وَالآجَامِ وَالظِّرَابِ وَالأَوْدِيَةِ وَمَنَابِتِ الشَّجَرِ ‏.

হাদীসে বর্ণিত এই দোয়ার বিশেষ একটি প্রেক্ষাপট আছে। এক জুমার দিনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুতবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল। নবীজির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, বৃষ্টিতে সম্পদ বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, রাস্তাঘাট বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আপনি আল্লাহর কাছে বৃষ্টি বন্ধের জন্য দোয়া করুন। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই হাত তুলে উল্লিখিত দোয়া করেন। দোয়াটির অর্থ : হে আল্লাহ, আমাদের ওপর নয়; বরং আমাদের আশেপাশে বৃষ্টি বর্ষণ করুন। টিলা, পাহাড়, ঝোপঝাড়, মালভূমি, উপত্যকা ও বনভূমিতে বর্ষণ করুন। [সহিহ বুখারি, ৯৬৭]

. ঝড়ের দোয়া পাঠ করা

বৃষ্টির সময় বৃষ্টির পাশাপাশি যদি ঝোড়ো বাতাস প্রবাতিহ হয়, তবে এ সময় ঝড়ের বিশেষ দোয়া পড়া সুন্নাহ। যখন ঝোড়ো বাতাস বইত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিম্নোক্ত দোয়া পড়তেন—

‏ اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ خَيْرَهَا وَخَيْرَ مَا فِيهَا وَخَيْرَ مَا أُرْسِلَتْ بِهِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا وَشَرِّ مَا فِيهَا وَشَرِّ مَا أُرْسِلَتْ بِهِ

অর্থ: হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে এর, এর মধ্যকার এবং এর সঙ্গে আপনার পাঠানো কল্যাণ চাই। আর আমি আপনার কাছে এর অনিষ্ট থেকে, এর ভেতরে নিহিত অনিষ্ট থেকে এবং যা এর সঙ্গে প্রেরিত হয়েছে তার অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই। [বুখারি: ৩২০৬ ও ৪৮২৯; মুসলিম: ৮৯৯]

. আল্লাহর ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকা

বৃষ্টি যদিও আল্লাহর রহমত হয়েই আসে, কিন্তু এর আড়ালে আল্লাহর আযাবও লুকিয়ে থাকতে পারে। পূর্ববর্তী কোনো কোনো জাতির ওপর বৃষ্টি আযাব হয়েও এসেছিল। তাই বৃষ্টি এলে আল্লাহ তাআলার আযাবের কথা ভেবে সন্ত্রস্ত থাকা উচিত।

আয়েশা রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মেঘ বা ঝড়ো হাওয়া দেখতেন, তখন তার চেহারায় ভয়ের ছাপ ফুটে উঠত। আয়েশা রা. বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমি দেখতে পাই, লোকেরা মেঘ দেখে খুব খুশি হয় এ আশায় যে, এতে বৃষ্টি হবে। আর আপনাকে দেখি যে, যখন আপনি মেঘ দেখেন, তখন আপনার চেহারায় ভয়ের ছাপ ফুটে ওঠে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হে আয়েশা, আমি এর মধ্যে আযাব না থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত নই। একটি জাতিকে ঝড়ো হাওয়া দ্বারা আযাব দেওয়া হয়েছে। আরেক জাতি আসমানি আযাব দেখে বলেছিল, এ তো মেঘ, যা আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করবে। [সহিহ মুসলিম: ১৯৭১]

. বৃষ্টিকে আল্লাহর রহমত বলে অভিহিত করা

একজন মুমিন বৃষ্টিকে আল্লাহর রহমত অভিহিত বলে করবে। এটা সুন্নাহ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বৃষ্টি দেখতেন, বলতেন, এ তো আল্লাহর রহমত। [সহিহ মুসলিম, ১৯৫৭]

. বৃষ্টিকে আল্লাহর অনুগ্রহ মনে করা

মুমিন বিশ্বাস করবে—একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহেই বৃষ্টি বর্ষিত হয়। বৃষ্টি বর্ষণের পেছনে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো শক্তি যেমন গ্রহ-নক্ষত্র, তারকাপুঞ্জ, মেঘমালা ইত্যাদির কোনো ক্ষমতা নেই। বরং এ সবকিছু মহান আল্লাহর সৃষ্টি ও ক্ষমতার অধীন। তাই বৃষ্টিকে একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ মনে করাই মুমিনের চরিত্র।

যায়েদ ইবনে খালিদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা হুদাইবিয়ার বছর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে বের হলাম। এক রাতে খুব বৃষ্টি হলো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নিয়ে ফজরের সালাত আদায় করলেন। এরপরে আমাদের দিকে ফিরে বললেন, তোমরা জানো কি তোমাদের রব কী বলেছেন? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। তখন তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন, আমার বান্দাদের মধ্যে কেউ আমার প্রতি বিশ্বাসী হয়েছে আর কেউ হয়েছে আমার প্রতি অবিশ্বাসী। যে বলেছে, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে আমরা বৃষ্টি লাভ করেছি, সে আমার প্রতি বিশ্বাসী এবং নক্ষত্রের প্রতি অবিশ্বাসী। আর যে বলেছে, অমুক অমুক নক্ষত্রের প্রভাবে আমরা বৃষ্টি লাভ করেছি, সে আমার প্রতি অবিশ্বাসী এবং নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাসী। [সহিহ বুখারি, ৮৪৬]

. বৃষ্টির পানি গায়ে লাগানো

আমরা প্রায় সবাই বৃষ্টির পানি গায়ে লাগাতে, বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই আমরা জানি না, বৃষ্টির পানি গায়ে লাগানো সুন্নাহ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনটি করতেন। আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, একবার আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে থাকা অবস্থায় বৃষ্টি নামল। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম গায়ের কাপড় খুললেন যেন শরীরে বৃষ্টির পানির স্পর্শ লাগে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি কেন এমন করলেন? তিনি বললেন,

لِأَنَّهُ حَدِيثُ عَهْدٍ بِرَبِّهِ تَعَالَى.

কেননা, এ বৃষ্টি তার মহান রবের কাছ থেকে মাত্রই এসেছে। [সহিহ মুসলিম, ১৯৫৬]

তাই, আমরা যদি বৃষ্টিতে ভেজার সময় রাসুলের (সা.) সুন্নাতটাকে স্মরণে রাখি, আশা করা যায়, আমাদের এই বৃষ্টিতে ভেজা ইবাদতে পরিণত হবে। 

. বৃষ্টির সময় দোয়া করা

যে সময়গুলোতে দোয়া কবুল হয়, বৃষ্টির সময় তার অন্যতম। সাহল ইবনে সাদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

ثِنْتانِ مَا تُرَدَّانِ: الدُّعاءُ عنْدَ النِّدَاءِ ‌وتَحْتَ ‌المطر

অর্থ : দুই সময়ের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। (এক.) আযানের সময়ের দোয়া। (দুই.) বৃষ্টির সময়ের দোয়া। [সহিহুল জামিয়িস সগির, ৩০৭৮]

তাই বৃষ্টির সময়টাকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে দোয়ায় মগ্ন হওয়া উচিত।

১০. ঝড়-বৃষ্টিকে ফূর্তির উপলক্ষ না বানানো

ভোগবাদের স্রোতে গা ভাসানো মানুষেরা সবকিছুর মধ্যেই আনন্দ-ফূর্তির উপলক্ষ খোঁজে। আজকাল বৃষ্টির মুহূর্তটাকেও অনেকে অর্থহীন আনন্দ উদযাপনের মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে। নাচ-গান, সিনেমা দেখা, লুডু খেলার মতো পাপ ও অনর্থক কাজে এই মহৎ সময়টাকে তারা নষ্ট করে ফেলে। এটা কোনো মুমিনের কাজ হতে পারে না। বৃষ্টির সময় একজন মুমিন বিনীত ও সন্ত্রস্ত থাকবে এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে উপরিউক্ত সুন্নাহগুলো পালন করার তাওফিক দান করুন।