article

পহেলা বৈশাখ উদযাপন : বাংলা সংস্কৃতির নামে হিন্দু সংস্কৃতি

৯ এপ্রিল, ২০২২, দুপুর ০২:৪৯

শায়খ আহমাদুল্লাহ

পহেলা বৈশাখ ও এর ক্রমবিকাশ সম্পর্কে অনুসন্ধান করলে আমরা এর তিনটি স্তর দেখতে পাই। ১. পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হতো জমিদার আমলে। জমিদারেরা বছরের শেষে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ফসলের খাজনা সংগ্রহ করত। সংগ্রহ করা হয়ে গেলে খুশি হয়ে পহেলা বৈশাখে মানুষের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করত। ২. জমিদারপ্রথা যখন বিলুপ্ত হয়ে গেল, তখন পহেলা বৈশাখ মানে ছিল হালখাতা। হালখাতা ছাড়া পহেলা বৈশাখে আর তেমন কিছুই হতো না। সারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে, শহরে-বন্দরে সব জায়গার সকল দোকানদার পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দোকান সাজিয়ে-গুছিয়ে ক্রেতাদের থেকে বাকি টাকা উসুল করত। ক্রেতাদেরকে কার্ড দিয়ে দাওয়াত দেয়া হতো। যাতে পহেলা বৈশাখ সকালে এসে আগের দেনা পরশোধ করে নতুন খাতা খোলেন। দেনা পরিশোধকে উপলক্ষ করে ক্রেতাদেরকে মিষ্টান্ন খাওয়ানো হতো। এই উপলক্ষে সবার মধ্যে আনন্দ-উৎসবের আবহ বিরাজ করত। এটা ছিল নিছক সামাজিক একটি উৎসব। এটিকে জাতীয়ভাবে উদযাপন করা হতো না। ৩. যেটি আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এটি শুরু হয়েছে ১৯৮৯ সালে। উইকিপিডিয়াতে এর বিস্তারিত তথ্য আছে। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য বই-পুস্তকেও এই তথ্য পাওয়া যায়। ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটে কিছু তরুণ শিক্ষার্থীর উদ্যোগে সর্বপ্রথম এখনকার আঙ্গিকে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। আর এদের মূলে ছিলেন তরুণ ঘোষ নামের কলকাতার একজন শিক্ষার্থী। তরুণ ঘোষের নেতৃত্বে কিছু শিক্ষার্থী পহেলা বৈশাখ উদযাপনের নবতর পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তখন থেকে পহেলা বৈশাখ ভোরে চারুকলা থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়ে কিছুদূর পথ প্রদক্ষিণ করে আবার চারুকলা এসে শেষ হতো। তরুণ ঘোষ কলকাতায় যেভাবে দেখেছেন, ঠিক তারই আদলে হিন্দুদের বিভিন্ন প্রতিমা, হিন্দুদের বিশ্বাস মতে বিভিন্ন দেব-দেবীর বাহন, বিভিন্ন জীব-জন্তুর মুখোশ সেই শোভাযাত্রায় তারা বহন করত। কিছুদিন যেতে না যেতেই এই আনন্দ শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে দেয়া হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। অর্থাৎ এটি কিছুদিনের মধ্যে এমন একটি নামে পরিবর্তিত হলো, যেটির সঙ্গে হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাসের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা কী? মঙ্গল শোভাযাত্রা হলো মূলত পহেলা বৈশাখের সকালে নারী-পুরুষ সকলে মিলে ঢোল-তবলার তালে তালে রাস্তায় বের হয়ে মিছিল, র‌্যালি ও শোভাযাত্রা বের করে মঙ্গল কামনা করা। মঙ্গল শোভাযাত্রায় ঢোল-তবলা বাজিয়ে হিন্দুদের দেব-দেবীর মূর্তি নিয়ে পশু-পাখির মুখোশ পরে নারী-পুরুষ একত্রে মিছিল করা হয়; এই কামনায় যে, যাতে মানবজীবনের কল্যাণ হয় এবং বিপদাপদ দূরীভূত হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় যেসব মূর্তি ও মুখোশ বহন করা হয়, এসব কি নিছক আর্ট ও সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য বহন করা হয়? উত্তর হলো, না। নিছক সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য ও আর্ট হিসেবে এসব বহন করা হয় না। বরং প্রত্যেকটি প্রাণী ও মূর্তির সঙ্গে হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাস জড়িত। মঙ্গল শোভাযাত্রায় বহনকৃত মুখোশগুলোর একটি হলো, পেঁচা। হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী পেঁচা মঙ্গলের প্রতীক। শুধু মঙ্গলের প্রতীকই নয়, এটা তাদের অন্যতম দেবী লক্ষ্মীর বাহন। পেঁচার মুখোশ বহন করলে লক্ষ্মী আসবে, মঙ্গল আসবে, কল্যাণ আসবে— এটা হিন্দুদের একটা বিশ্বাস। ঠিক তেমনিভাবে হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী ইঁদুর গণেশের বাহন। হনুমান রামের বাহন। হাঁস স্বরস্বতীর বাহন। তেমনিভাবে হাতি, বাঘ ও সিংহ দূর্গার বাহন। গাভী রামের সহযাত্রী। ময়ূর কার্তিকের বাহন। ক্ষ্যাপা ষাঁড় শিবের বাহন। উল্লিখিত প্রত্যেকটি প্রাণীর মুখোশ কথিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় বহন করা হয়। এছাড়াও সূর্য হিন্দুদের অন্যতম একটি দেবতা। আপনারা মঙ্গল শোভাযাত্রায় সূর্যের আকৃতির মানুষের মাথা প্রচুর পরিমাণে দেখতে পাবেন। সুতরাং বলা যায়, এগুলো নিছক আর্ট ও সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য বহন করা হয় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা কোনো স্থানীয় ও সর্বজনীন উৎসব নয়। এটি স্রেফ হিন্দু সাম্প্রদায়িক উৎসব। আমরা বলতে পারি, হিন্দুরা ১২ মাসে ১৩ পূজায় যেসব দেব-দেবীর পূজা করে, আমরা পহেলা বৈশাখে হিন্দুদের দেব-দেবীর সঙ্গে সম্পর্কিত প্রাণীর মুখোশ বহন করে এক মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে একদিনেই করে ফেলি। কেউ বলতে পারেন, এসব মূর্তি ও মুখোশ স্রেফ আর্ট ও সৌন্দর্যের জন্য বহন করা হয়। আমি বিনয়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলব যে, বিষয়টি মোটেও এরকম নয়। আপনি মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজক, চারুকলা ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন শিক্ষকদের এই সম্পর্কিত বক্তব্যগুলোকে একত্র করলে নিশ্চিত হতে পারবেন যে, এগুলো স্রেফ আর্টের জন্য করা হয় না। বরং মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয় তাদের মতানুসারে দেশের মানুষের সমৃদ্ধি ও কল্যাণের জন্য। অর্থাৎ এর সঙ্গে বিশ্বাসের সম্পর্ক রয়েছে। বিডিনিউজ২৪.কম বাংলাদেশের অত্যন্ত পরিচিত একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। এই পোর্টালটিতে ২০১৪ সালের ১৪ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ এবং মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল “লক্ষ্মী-পেঁচায় সমৃদ্ধি, গাজী ও বাঘ দুঃসময়ের কাণ্ডারি”। সে রিপোর্টে আয়োজকদের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। এর আলোকেই এই শিরোনাম দেয়া হয়েছে। কথিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় লোকজ ঐতিহ্যের নামে হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী অনুষ্ঠান পালন করা হচ্ছে। এটি হিন্দুদের পূজার ফটোকপি বৈ কিছু নয়। এই হলো মঙ্গল শোভাযাত্রার রহস্য। মুসলিম হিসেবে আমরা সকলে বিশ্বাস করি যে, মঙ্গল এবং অমঙ্গলের মালিক একমাত্র আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তায়ালা। আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীতে যত কিছু আছে সব আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহর প্রত্যেক সৃষ্টিই আল্লাহর মুখাপেক্ষী। যারা নিজেরাই আল্লাহর মুখাপেক্ষী, তারা অন্য কাউকে কল্যাণ ও মঙ্গল এনে দেবে, এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বিশ্বাস প্রসূত। এটি সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে শিরকের শামিল। খ্রিস্টানরা ঈসা (আ.) ও তাঁর মা মারইয়াম (আ.)-এর পূজা করে এবং তাঁদের কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সূরা মায়িদাহর ১৭ নম্বর আয়াতে তাদের এই বিশ্বাসের বিরুদ্ধে একটি চমৎকার যুক্তি তুলে ধরেছেন। আল্লাহ সুবহানা তায়ালা বলেন, قُلْ فَمَن يَمْلِكُ مِنَ اللَّـهِ شَيْئًا إِنْ أَرَادَ أَن يُهْلِكَ الْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَأُمَّهُ وَمَن فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ‘আল্লাহ যদি মারইয়াম-তনয় ঈসা, তার মাতা ও দুনিয়ার সকলকে যদি ধ্বংস করতে চান, তাঁকে বাধা দেয়ার কে আছে?’ উত্তর হলো, কেউ নেই। সুতরাং তাদের উপাসনা ও পূজা করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। তারা নিজেরাই ধ্বংসশীল। যারা নিজেরা নিজেদেরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না, তারা অন্যদেরকে কীভাবে রক্ষা করবে? অতএব কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য একমাত্র মহান রাব্বুল আলামীনের ইবাদত করতে হবে। তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করা শিরক। আমরা সূরা ফাতিহায় প্রতিদিন দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিয়ে থাকি যে, إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ ‘আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদাত করি এবং একমাত্র আপনার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি।’ (সূরা ফাতিহা: আয়াত ৫) এই হলো আমাদের মুখের কথা। এই হলো আমাদের দাবি। আর যদি আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করি, এর মানে হলো, পেঁচার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। বাঘ, ভল্লুক, হরিণের কাছে সাহায্য চাই। এতে আমাদের কথা ও কাজে অমিল তৈরি হয়। এটি সম্পূর্ণরূপে শিরক। বর্ষবরণের নাম দিয়ে আমাদের সাধারণ মুসলিম ভাই ও বোনদেরকে বলা হচ্ছে, এটি বাঙালি সংস্কৃতি। অথচ এই উপলক্ষে যে কাজগুলো হয়ে থাকে, কোনোটির সাথে মুসলিমের বিশ্বাস যায় না। বরং এগুলো সম্পূর্ণ মুসলিমের বিশ্বাস-বিরুদ্ধ, মুসলিমের ঈমান-বিধ্বংসী। সরাসরি বললে এগুলো সব মন্দিরের আয়োজন। মন্দির থেকে কিছু আয়োজনকে এনে সেটাকে বাঙালি সংস্কৃতির প্রলেপ দিয়ে, লেবাস পরিয়ে সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ এটাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। যেটি আমাদের ঈমানকে হরণ করছে, যেটি আমাদেরকে শিরকে নিমজ্জিত করছে। আমরা না জেনে ও না বুঝে শিরকে হাবুডুবু খাচ্ছি। পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রা সম্পর্কে আমি কিছু কথা বললাম। এছাড়া আরো যেসব কর্মকাণ্ড আছে যেমন: পান্তা-ইলিশ খাওয়া, এটিও মূলত হিন্দুদের পূজার একটি অনুষঙ্গ। হিন্দু সংস্কৃতি থেকে এটি ধার করে আনা হয়েছে। হিন্দুরা আশ্বিন মাসের শেষে রান্না করে এক ধরনের উপবাস করে। কার্তিক মাসের সকালে পূজা করে আগের দিনের রান্না করা পান্তাভাত খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করে। ঠিক তারই আদলে বাঙালি সংস্কৃতির নাম দিয়ে পহেলা বৈশাখের সকালে পান্তাভাত খাওয়া হয় এবং এটাকে বাঙালি সংস্কৃতি হিসাবে প্রচার করা হয়। একই আদলের আরেকটি উৎসবের নাম চৈত্র সংক্রান্তি। চৈত্র সংক্রান্তি একটি পুজাই আছে পৃথকভাবে। অনলাইনে সার্চ দিলে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন। ঢোল-তবলার তালে তালে হিন্দুদের পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পহেলা বৈশাখও ঢোল-তবলার তালে তালেই উদযাপিত হয়। হিন্দু মেয়েরা কপালে সিঁদুর পরে। এটি তাদের ধর্মীয় একটি চিহ্ন। পহেলা বৈশাখেও বাঙালি মেয়েরা কপালে লাল টিপ ব্যবহার করে। নিঃসন্দেহে এটি হিন্দুদের অন্ধ অনুকরণ। কুলা পহেলা বৈশাখের অন্যতম অনুষঙ্গ। পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় কুলার প্রদর্শনী দেখতে পাবেন। নিঃসন্দেহে কুলা আমাদের বাঙালি জাতির ঐতিহ্য। কিন্তু কুলা ছাড়া তো আরো বহু কিছুই আছে। আপনারা অনেকেই জেনে থাকবেন, হিন্দুদের পূজার সময় মূর্তির সামনে যেসব জিনিস উপস্থাপন করা হয় তা কুলায় করে উপস্থাপন করা হয়। অর্থাৎ কুলায় করে কিছু বহন করা পূজার একটি আলামত। ঠিক এটাকেই পহেলা বৈশাখে কপি-পেস্ট করা হয়েছে। কোথায় চলে যাচ্ছি আমরা? কোথায় আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এই উৎসবটিকে জাতীয় উৎসব এবং এটাকে আমাদের বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে এবং বলা হচ্ছে এটা নাকি সর্বজনীন উৎসব। তাহলে দুই ঈদের সিরিয়াল নম্বর কত? অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ দুই ঈদের চেয়েও বড় উৎসব। এটি অত্যন্ত আফসোস ও আক্ষেপের বিষয় যে, পহেলা বৈশাখকে ঈদের বিকল্প এবং ঈদের চেয়ে শক্তিশালী উৎসব হিসেবে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা এক শ্রেণীর মিডিয়া করে চলেছে। রীতিমত তারা প্রচার করছে, এটি বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় উৎসব। এটাকে জাতীয় উৎসবের স্থান দেয়ার জন্য যা যা করা দরকার তার সব কিছুই তারা করে। এটি নিঃসন্দেহে একটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি এটি একটি সাংস্কৃতিক জুলুম। আমাদের সকলকে এ বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। এটি আমাদের সংস্কৃতি নয়। এটি হিন্দুদের সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতির নামে এটি আমাদেরকে গেলানো হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এর পরিণাম ভয়াবহ। এর ফলে আমাদের ঈমানহারা হতে হবে, আমাদের চেতনাশূন্য হতে হবে এবং আমাদেরকে জাহান্নামমুখী হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে হেফাজত করুন।