
শীতকালের বিশেষ আমল
১৭ জানুয়ারী, ২০২৪, রাত ১২:০০
শায়খ আহমাদুল্লাহ
শায়খ আহমাদুল্লাহ
গরমের তীব্রতা ও শীতের প্রচণ্ডতা আমাদেরকে জাহান্নামের আযাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এগুলো জাহান্নামের আযাবের ছোট্ট নিদর্শন মাত্র। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
وَاشْتَكَتِ النَّارُ إِلَى رَبِّهَا، فَقَالَتْ: يَا رَبِّ أَكَلَ بَعْضِي بَعْضًا، فَأَذِنَ لَهَا بِنَفَسَيْنِ، نَفَسٍ فِي الشِّتَاءِ وَنَفَسٍ فِي الصَّيْفِ، فَهُوَ أَشَدُّ مَا تَجِدُونَ مِنَ الْحَرِّ، وَأَشَدُّ مَا تَجِدُونَ مِنَ الزَّمْهَرِيرِ
জাহান্নাম তার প্রতিপালকের কাছে অভিযোগ করল, হে আমার প্রতিপালক! (গরমের তীব্রতায়) আমার এক অংশ আরেক অংশকে গ্রাস করে ফেলেছে। ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে দু’টি নিঃশ্বাস ফেলার অনুমতি দিলেন, একটি শীতকালে আর একটি গ্রীষ্মকালে। আর সে দু’টি হলো, তোমরা গ্রীষ্মকালে যে প্রচণ্ঠ উত্তাপ এবং শীতকালে যে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অনুভব কর।[1]
জাহান্নাম গরম যে নিঃশ্বাস ফেলে সেটাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন গ্রীষ্ম হিসেবে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময়ে বণ্টন করে থাকেন। আর জাহান্নাম ঠাণ্ডা যে নিঃশ্বাস ফেলে, সেটাকে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময়ে শীত হিসেবে বন্টন করে থাকেন।
জাহান্নামের দু’টি বিভাগ আছে। একটি হলো ‘নার’, আরেকটি হলো ‘যামহারীর’। নার বলা হয় আগুন আর যামহারীর বলা হয় ঠাণ্ডাকে। দু’টি সম্পর্কেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআন কারীমে বলেছেন। আল্লাহর নাফরমান ও অবাধ্য বান্দাদের দুই ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে। কাউকে ‘নার’ দিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে, কাউকে ‘যামহারীর’ দিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে, আবার কাউকে উভয়টা দিয়েই শাস্তি দেওয়া হবে।
বিশেষত শীতকালে বিশেষ কিছু ইবাদতের সুযোগ রয়েছে, যা অন্য সময়ে করা হয়ে ওঠে না বা করার সুযোগ হয় না। আজ আমরা সেসব আমল নিয়ে আলোচনা করব, যাতে সবাই আমল করেন।
১. জাহান্নামের আযাবের ভয়ে সাবধান হওয়া: উপরে আমরা বলেছি, শীতের তীব্রতার উৎপত্তি জাহান্নামের নিঃশ্বাস থেকে হয়ে থাকে। সুতরাং শীতের প্রণ্ডতা পৃথিবীবাসীর কাছে জাহান্নামের বার্তা নিয়ে আগমন করে। শীত আমাদেরকে জাহান্নামের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এজন্য শীতকালে মুমিনের প্রথম করণীয় হলো জাহান্নামের ভয়ে ভীত হওয়া এবং জাহান্নামে গমনের কারণ হয়, এরকম সকল বদ আমল পরিত্যাগ করা। সকল-ফরয ওয়াজিব আদায় করা, সর্বোপরি কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনার মাধ্যমে নিজের মধ্যে জান্নাতের উপযোগিতা সৃষ্টি করা।
২. নফল সিয়াম পালন করা: এটা শীতকালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল।
গরমে ঘাম ঝরার কারণে শরীর দুর্বল হয়ে যায়, আবার দিনগুলো হয় দীর্ঘ, ফলে গরমকালে সিয়াম পালন করা কঠিন। পক্ষান্তরে শীতে শরীর দুর্বল হয় কম, তদুপরি দিন ছোট হওয়ার কারণে বেশি সময় উপবাস থাকতে হয় না। যেহেতু শীতকালে সিয়াম পালন করতে কষ্ট কম হয়, কম কষ্টে অধিক সাওয়াব লাভ করা যায়, এজন্য শীতকালের সিয়াম পালনকে গনীমতের সঙ্গে উপমা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং শীতকালের এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করা আমাদের কারো জন্য উচিত হবে না।
৩. তাহাজ্জুদ আদায় করা: তাহাজ্জুদ আদায়ের জন্য শীতকাল উপযুক্ত সময়। কেননা এই সময়ে রাত দীর্ঘ হয়। ফলে এশার পর পর ঘুমিয়ে পড়লে তাহাজ্জুদের সময় পর্যন্ত পর্যাপ্ত ঘুম হয়ে যায়। তাহাজ্জুদের সময় উঠে তাহাজ্জুদ আদায় করে সিয়ামের নিয়তে সাহরী খাওয়া যেতে পারে। তাহাজ্জুদ এবং সিয়াম দুইটাই শীতকালে আদায় করা সহজ। সামান্য চেষ্টা করলেই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ আমল করা সম্ভব।
কিন্তু আমরা এই মৌসুমেও এই আমলগুলো করতে পারি না। রাতের এই দীর্ঘ সময়টাকে আমরা তাহাজ্জুদের জন্য গনীমত মনে করি না বরং এই সময়টাকে অবহেলায় আর আলস্যে কাটিয়ে দিই। কারণ শয়তান আমাদেরকে করতে দেয় না, আমাদেরকে এই মহা গুরুত্বপূর্ণ আমল থেকে বিরত রাখে। সে আমাদেরকে প্রবঞ্চনা দেয় যে, এখনো সময় আছে। আরো কিছুদিন পর থেকে শুরু করতে পারবে। এভাবে আমাদেরকে আমল থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এভাবে বিলম্ব করতে করতে যখন আমাদের আমল করার শক্তি থাকে না, শরীর দুর্বল হয়ে যায়, শরীরে বিভিন্ন অসুখ বাসা বাঁধে— তখন বিলম্ব করার জন্য আফসোস হয়। কিন্তু এই আফসোস কোনো কাজে আসে না।
৪. ওযুর ব্যাপারে বিশেষ যত্নবান হওয়া: অন্য সময়ের চেয়ে শীতকালে ওযুর ব্যাপারে যত্নবান হওয়া বেশি প্রয়োজন। কারণ শরীর শুষ্ক থাকার কারণে ভালোভাবে না ধুলে পশমের গোড়া শুকনা থেকে যায়। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) শীতকালে ভালোভাবে ওযু করার নির্দেশ দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত,
أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ قَالَ: أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللهُ بِهِ الْخَطَايَا وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ؟ قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ، وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ، وَانْتِظَارُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الصَّلَاةِ، فَذَلِكُمُ الرِّبَاطُ.
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন কাজ সম্পর্কে জানাব না, যা করলে আল্লাহ পাপরাশি দূর করে দেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করেন?’ সাহাবীরা বললেন, ‘বলুন, হে আল্লাহর রাসূল!’ তিনি বললেন, ‘কষ্টের সময় ভালোভাবে ওযু করা, মসজিদে গমনের জন্যে বেশি পদচারণা করা এবং এক সালাতের পর আরেক সালাতের জন্যে প্রতীক্ষা করা। আর এগুলোই হলো সীমান্ত প্রহরা।[3]
বিশেষভাবে ধূলাবালির কারণে পায়ের গোড়ালি বেশি শুকনা থাকে। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) গোড়ালি ভালোভাবে ধোয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন। আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে মক্কা থেকে মদীনায় ফিরছিলাম। পথিমধ্যে আমরা যখন এক জায়গায় পানির কাছে পৌঁছালাম, তখন কিছু সংখ্যক লোক আসরের সালাতের সময় তাড়াহুড়া করল। এরা ওযুও করল তাড়াহুড়া করে। আমরা যখন তাদের কাছে পৌঁছালাম, তখন তাদের পায়ের গোড়ালিসমূহ এমনভাবে প্রকাশ পাচ্ছে যে, তাতে পানি পৌঁছেনি। এ দেখে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন,
وَيْلٌ لِلْأَعْقَابِ مِنَ النَّارِ، أَسْبِغُوا الْوُضُوءَ
পায়ের গোড়ালিগুলোর জন্য (শুষ্কতার কারণে) জাহান্নাম। তোমরা ভালোভাবে ওযু করো।[4]
শীতকালে অনেকে জোর করে ওযু ধরে রাখেন। অনেকে তো আসরের ওয দিয়ে এশার সালাতও আদায় করেন। এমনটা করা অনুচিত। এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর, দীনি দৃষ্টিকোণেও প্রশংসনীয় নয়। যারা শীতের ভয়ে জোর করে ওযু ধরে রাখেন, এর মাধ্যমে তারা কষ্টের সময়ে ওযু করার বিশেষ ফযীলত থেকে বঞ্চিত হবেন।
৩. মোজার উপর মাসেহ করা: বিশেষত শীতকালে মোজার উপরে মাসেহ করা উচিত। সবসময় না হলেও অন্তত মাঝেমধ্যে হলেও করা উচিত। কারণ এটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের একটি অন্যতম নিদর্শন, নবী করীম (সা.)-এর একটি আমল এবং আল্লাহ তাআলার দেওয়া অন্যতম একটি ছাড়। নবী কারীম সা. বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ أَنْ تُؤْتَى رُخَصُهُ، كَمَا يُحِبُّ أَنْ تُؤْتَى عَزَائِمُهُ
সাধারণ নির্দেশসমূহ মান্য করা যেমন আল্লাহর কাছে প্রিয়, তেমনিভাবে আল্লাহর দেওয়া ছাড় গ্রহণ করাও প্রিয়।[5]
অনেক আলেমের মতে, মাসেহ করার চেয়ে পা ধোয়া উত্তম; আবার অনেকের মতে, মাসেহ করা উত্তম পা ধোয়ার চেয়ে। এ ব্যাপারে দুই রকম মত থাকলেও এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই যে, নবী (সা.)-এর অনুসরণে মোজার ওপর মাসেহ করলে সাওয়াব হবে।
৫. সালাতের সময় মুখমণ্ডল না ঢাকা: যখন শীত তীব্র আকার ধারণ করে তখন শীত থেকে বাঁচার জন্য অনেকে চাদড় মুড়ি দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে ফেলে। বিশেষভাবে এটি মরুভূমি অঞ্চলে লক্ষ করা যায়। সাধারণ অবস্থায় নাক-মুখ ঢাকায় সমস্যা নেই। কিন্তু সালাত আদায়ের সময় যেন নাক-মুখ-চোখ ঢাকা না থাকে। কারণ সালাতের সময় নাক-মুখ-চোখ ঢেকে রাখা নিষিদ্ধ।
৬. আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা: মুমিন শীতের সময় আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করবেন। এজন্য যে, আল্লাহ তাআলা আমাকে শীত নিবারণের সামর্থ দিয়েছেন। বহু পশু-পাখি এমনকি অনেক মানুষেরও শীত নিবারণের ব্যবস্থা নেই। আল্লাহ তাআলা এ সম্পর্কে কুরআন কারীমে আমাদেরকে কোনো কোনো আয়াতে ইঙ্গিতও দিয়েছেন যে, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পোশাকের ব্যবস্থাপনা দিয়েছেন। যার মাধ্যমে তোমরা শীত থেকে আত্মরক্ষা করতে পারো।
৭. শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো: শীতকালে মুমিনের অন্যতম করনীয় হলো, শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আতর্মানবতার সেবা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা ও নবী কারীম (সা.)-এর নির্দেশ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ، ارْحَمُوا مَنْ فِي الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ، الرَّحِمُ شُجْنَةٌ مِنَ الرَّحْمَنِ، فَمَنْ وَصَلَهَا وَصَلَهُ اللَّهُ وَمَنْ قَطَعَهَا قَطَعَهُ اللَّهُ
আল্লাহ তাআলা দয়ালুদের ওপর দয়া করেন। তোমরা জমিনবাসীর ওপর দয়া করো, আসমানবাসী তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। দয়া রাহমান হতে উদগত। যে ব্যক্তি দয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, আল্লাহ তাআলাও তার সঙ্গে দয়ার সম্পর্ক বজায় রাখেন। আর যে ব্যক্তি দয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহ তাআলাও তার সাথে দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করেন।[6]
দুঃখজনকভাবে এটি আমাদের জীবন থেকে নানা কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা আস্তে আস্তে নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছি, দিনদিন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি। আত্মকেন্দ্রিকতার গণ্ডি থেকে বের হতে হবে। মানুষ শীতের কষ্টে মারা যাবে, এটি আমাদের জন্য লজ্জার, এটি আমাদের জন্য আক্ষেপের এবং দুঃখের বিষয়।
শীতের আমল সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করা হয়েছে। সবাই এর ওপর আমল করার চেষ্টা করব। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দিন।
তথ্যসূত্র
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৩৭
[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫১
[4] সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪১
[5] মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা-২৬৪৭২
[6] সুনান তিরমিযী, হাদীস ১৯২৪