
অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণে ইসলাম
৪ মার্চ, ২০২৩, রাত ১২:০০
শায়খ আহমাদুল্লাহ
শায়খ আহমাদুল্লাহ
একটি মুসলিম দেশে, মুসলিম ভূখণ্ডে বা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে অমুসলিমদের সাথে মুসলিমদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, তাদের প্রতি আমাদের কী ধরনের দায়বদ্ধতা রয়েছে, আমাদের ওপর তাদের কী কী হক আছে— মুসলিম হিসেবে বিষয়গুলো জানা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
ইসলাম এসেছে সমগ্র মানবজাতির অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য। ইসলাম শুধু মুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণের কথা বলে না, ইসলাম মুসলিমদের অধিকারের কথাও বলে। অমুসলিমদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা উচিত, এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীস আমাদেরকে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছে। নবীজি ও সাহাবা কিরামের আচরণে এর বিস্তর উদাহরণ রয়েছে।
অমুসলিমদের সঙ্গে সহাবস্থান: যে মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রে অমুসলিমরাও বসবাস করে, যে মুসলিম রাষ্ট্র মুসলিম-অমুসলিম সবাইকে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং সবার অধিকার নিশ্চিত করে— সেই রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিককে কুরআন-সুন্নাহর ভাষায় যিম্মী, মুসতামান-সহ বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়। এই ধরনের অমুসলিমদের ব্যপারে আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে বলেছেন, দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করেনি, তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।[1]
এই আয়াত থেকে বোঝা গেল, ইসলাম মুসলিমদেরকে অমুসলিমের সাথে সুন্দর, সদয় ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করতে নির্দেশ দেয়। এমনকি পশুপাখি, পোকা-মাকড় ইত্যাদির অধিকারও নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়। রাসূল (সা.) একবার পুড়িয়ে দেওয়া একটা পিঁপড়ার টিবি দেখতে পেয়ে বললেন, ‘কে এগুলো পুড়িয়েছে?’ সাহাবা কিরাম বললেন, ‘আমরা পুড়িয়েছি।’ তখন তিনি বললেন, আগুনের রব ব্যতীত আগুন দিয়ে কিছুকে শাস্তি দেওয়া কারো জন্য সমীচীন নয়।[2]
এজন্যই আমাদের নবী রাহমাতুল লিল-আলামীন—সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমত। তিনি মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল মানবজাতির এবং অন্য সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য দয়া ও অনুকম্পা হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন।
মুসলিম ভূখণ্ডে বসবাসরত অমুসলিমদের নিরাপত্তা প্রদান: যেসব অমুসলিম মুসলিম দেশের শাসনব্যবস্থা মেনে নিয়ে মুসলিম ভূখণ্ডে বসবাস করে, তাদের নিরাপত্তার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিপ্রাপ্ত কোনো লোককে হত্যা করে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধ চল্লিশ বছরের দূরত্ব থেকে পাওয়া যাবে।[3]
অর্থাৎ এরূপ ব্যক্তি জান্নাতে যেতে পারবে না। এ থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, ইসলাম অমুসলিমদের অধিকারও সংরক্ষণ করে। ইসলাম তাদেরকে স্বাধীনভাবে বসবাসের সুযোগ দেয়। উপরন্তু মুসলিমদেরকে তাদের সাথে উত্তম আচরণ করার আদেশ করে। এজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখি, ইসলামের প্রথম যুগে সাহাবা কিরামের আচরণে মুগ্ধ হয়ে বহু অমুসলিম ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন।
আমরা সবাই ঐতিহাসিক মদীনা সনদের কথা জানি। রাসূল (সা.) যখন মক্কা থেকে মুশরিকদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে মদীনায় হিজরত করলেন, তখন মাদীনায় ইহুদি, পৌত্তলিক, অগ্নিপূজকসহ বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্রের মানুষ ছিল। নবীজি মদীনায় এসে সর্বপ্রথম তাদের সাথে সহাবস্থানের চুক্তি করেছিলেন। সেই চুক্তিটাকেই আমরা মদীনা সনদ হিসেবে জানি। চৌদ্দশ বছর আগের মদীনা সনদ আজও পৃথিবীতে প্রাসঙ্গিক। এখনো পৃথিবীর রাষ্ট্রতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ নবী কারীম (সা.) প্রবর্তিত ঐতিহাসিক মদীনা সনদের ধারাগুলো নিয়ে গবেষণা করেন এবং প্রশংসা করতে বাধ্য হন। মদীনা সনদের একটি ধারা ছিল— প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে এবং মদীনা রাষ্ট্রকে হেফাজত করবার জন্য একে অপরকে সহযোগিতা করবে। মুসলমানদের ওপর বহিঃশত্রু আক্রমণ করলে মুসলমানদের পক্ষ হয়ে ইহুদিরা লড়বে, ইহুদিদের ওপর আক্রমণ হলে মুসলমানরা মদীনা রাষ্ট্রকে হেফাজত করবার জন্য ইহুদিদের পক্ষ হয়ে বহিঃশত্রুর মোকাবেলা করবে। এরকম আরো অনেক চুক্তি ছিল, যেগুলো থেকে বোঝা যায়, যে ভূখণ্ডে বিভিন্ন ধর্ম-গোত্রের মানুষ একত্রে বসবাস করে, সেখানে নিরাপত্তার ক্ষেতে একে অন্যের সহযোগী হবে।
যুদ্ধাবস্থায়ও অমুসলিমদের উপাসনালয়ে হামলা করা নিষিদ্ধ: ইসলামের বিধান হলো, ভিন্ন ধর্মের উপসনালয়ে সাধারণ অবস্থায় তো বটেই, যুদ্ধাবস্থায়ও হামলা করা যাবে না। কোনো ধর্মীয় পুরোহিতের প্রতি অস্ত্র তাক করা যাবে না। কোনো উপসনালয় জ্বালিয়ে দেওয়া যাবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনো জনপদে সৈন্যদল প্রেরণকালে বলতেন, আমি তোমাদের (কয়েকটি উপদেশ দিয়ে) প্রেরণ করছি: (যুদ্ধক্ষেত্রে) তোমরা বাড়াবাড়ি করবে না, ভীরুতা দেখাবে না, কারো চেহারা বিকৃত করবে না, কোনো শিশুকে হত্যা করবে না, কোনো গির্জা জ্বালিয়ে দেবে না এবং কোনো গাছ উৎপাটন করবে না।[4]
যে ধর্ম যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের সঙ্গে এরূপ আচরণের নির্দেশ দেয়, সেই ধর্ম সাধারণ অবস্থায় এবং স্বাভাবিক পরিবেশে অমুসলিমের সঙ্গে কী ধরনের আচরণের আদেশ করে, তা সহজেই অনুমেয়। এজন্য আমরা দেখতে পাই, মুসলমানদের সোনালি যুগে কোনো দেশে মুসলিম সৈন্য প্রবেশ করলে সাধারণ মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে ইসলামধর্ম গ্রহণ করত। যুদ্ধ হতো শুধু সৈন্যদের সঙ্গে, বেসামরিক নাগরিকদের কিছুই বলা হতো না। তবু তারা ইসলাম গ্রহণ করত। কারণ তারা এর আগে দেখেছে, যুদ্ধ শুধু ধ্বংসযজ্ঞ বয়ে আনে। কোনো জনপদে বিদেশি সৈন্য এলে তারা সেখানকার পরিবেশ ধ্বংস করে দিত। একমাত্র মুসলিম সৈন্যরাই ছিলেন ব্যতিক্রম। মুসলিমদের অনুপম চরিত্র দেখে ইসলামের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় নিত।
অমুসলিমদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করা বৈধ: ইসলাম কখনোই কোনো অমুসলিমের অধিকার হরণ করার কথা বলে না। বরং মুসলমান অমুসলিমের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে এবং তার থেকে বৈধ, হালাল খাবারও গ্রহণ করতে পারবে। রাসূল (সা.) নিজে অমুসলিমদের ঘরে খাবার খেয়েছেন এবং অমুসলিমকে তিনি নিজে খাইয়েছেন। হাদীসে বর্ণিত আছে, আনাস ইবনু মালিক (রা.) হতে বর্ণিত, এক ইহুদি মহিলা নবী (সা.)-এর কাছে বিষ মিশ্রিত বকরী নিয়ে এলো। সেখান থেকে কিছু অংশ তিনি খেয়েছেন।[5]
অমুসলিমদের সঙ্গে সামাজিক কাজকর্ম করা যাবে: অনেক সাহাবা কিরাম অমুসলিমের অধীনে কাজ করেছেন এবং অমুসলিমকে দিয়ে নিজেদের কাজ করিয়েছেন। আলী (রা.) কূপ থেকে প্রতি বালতি পানি উত্তোলনের বিনিময়ে একটি করে খেজুর দেবে, এই শর্ত ইহুদির কাজ করেছেন।[6]
রাসূল (সা.) এক ইহুদির কাছে বর্ম বন্ধক দিয়ে কিছু ঋণ এনেছিলেন।[7] আম্মাজান আয়েশা, আলী, ও উমর (রা.) প্রমুখ অমুসলিম প্রতিবেশীর বাসায় খাবার আদান-প্রদান করতেন।[8] বোঝা গেল, বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে অমুসলিমদের সঙ্গে সামাজিক কাজকর্ম করা যাবে।
ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা যাবে না: ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। কুরআন-সুন্নাহ কাউকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করার নির্দেশ দেয় না। সাম্য, শান্তি ও ন্যায়ের ধর্ম ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণের শাশ্বত আহ্বান সবসময় বিরাজমান ছিল এবং থাকবে। কিন্তু ইসলাম গ্রহণে কাউকে বাধ্য করে না। কুরআন কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেন, দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।[9]
অমুসলিমদের সঙ্গে কেমন ছিল নবীজির আচরণ
অমুসলিমদের কেমন আচরণ করতে ইসলাম নির্দেশ দেয়, এ ব্যাপারে আমরা নবীজির ব্যক্তিগত আচরণের মধ্য দিয়েও আমরা জানতে পারি। সুন্নাহ ও ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, রাসূলুল্লাহ (সা.) ভিন্ন ধর্মের মানুষকে মানুষ হিসেবে তার প্রাপ্য সম্মান দিতেন। অমুসলিম প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচার করতেন। অমুসলিমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইসলাম গ্রহণ করেছে প্রিয়নবী (সা.)-এর চারিত্রিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে।
একজন কাফের নেতাকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে এনে মসজিদে নববীর খুটির সাথে বেঁধে রাখা হলো। রাসূল (সা.) এসে দেখেন, তার হাত খুব শক্ত করে বাঁধা, এতে তার কষ্ট হচ্ছে। এটি দেখে নবী কারীম (সা.) বললেন, তার বাঁধনটা একটু আলগা করে দাও। সাহাবারা তা-ই করলেন।[10]
আবদুল্লাহ বিন সালাম ইহুদিদের পণ্ডিত ছিলেন। তিনি নবী কারীম (সা.)-এরর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা ও মহানুভবতা দেখে প্রকাশ্যে কালিমা শাহাদাহ পাঠ করে ইসলামে দিক্ষীত হন। এভাবে দলে দলে মানুষ ইসলামধর্ম গ্রহণ করেছে মহানবী (সা.)-এর চারিত্রিক মাধুর্যে বিমুগ্ধ হয়ে।
মক্কা বিজয়ের সময় মক্কার চৌকাঠে হাত দিয়ে বললেন, মক্কার লোকেরা, তোমরা আমার কাছে কী আশা কর? তারা বলল, আমরা তোমাকে ভ্রাতুষ্পুত্র হিসেবে আশা করি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা করবে। তখন তিনি বললেন, ইউসুফ (আ.) যেভাবে তার ভাইদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বলেছিলেন ‘আজ তোমাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়া হবে না’, তদ্রূপ আমিও তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম।[11] যারা জুলুম করতে করতে পিঠ দেয়ালে ঠেকেয়েছে, বরং দেশাত্যাগে বাধ্য করেছে— তাদের সঙ্গে রক্তপাতহীন ক্ষমার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে নবী-রাসূল ছাড়া আর কারো মধ্যে দেখাতে পারবেন না।
রাসূল (সা.)-এর একজন ইহুদি সেবক ছিল। সে একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে নবী কারীম (সা.) তাকে দেখতে তার বাড়িতে গিয়ে তার সেবা-শুশ্রূষা করেন, পাশে বসে সান্ত্বনা দেন। এরপরে তাকে ইসালামের দাওয়াত দেন। তখন সে তার পিতার পরামর্শে কালিমা শাহাদাহ পাঠ করল।
আমাদেরও উচিত ইসলামের নির্দেশনা এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দেখানো পদ্ধিতিতে অমুসলিম প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদাচার করা। আলহামদু লিল্লাহ, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মীয় সহাবস্থানে বিশ্বাসী। যার কারণে বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত বড় কোনো ধর্মীয় দাঙ্গা হয়নি। পক্ষান্তরে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে অহরহ দাঙ্গা বাঁধতে দেখা যায়। সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করে।
আল্লাহ তাআলা কিয়ামত পর্যন্ত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে শান্ত রাখুন এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত হোক। ধর্মীয় দাঙ্গা ও ফিতনা-ফাসাদ থেকে আমাদেরকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন।
[1] সূরা মুমতাহিনা, আয়াত ৮
[2] সুনান আবু দাঊদ, হাদীস ২৬৭৫
[3] সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৯১৪
[4] মুসান্নাফ আবদির রাযযাক, হাদীস ৯৪৩০
[5] সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৭৪
[6] সুনান তিরমিযী, হাদীস ২৪৭৩
[7] সহীহ বুখারী, হাদীস ২৩৮৬
[8] সুনান আবু দাঊদ, হাদীস ৫১৫২
[9] সূরা বাকারা, হাদীস ২৫৬
[10] সহীহ বুখারী, হাদীস ২২৯১
[11] সুনান বায়হাকী, হাদীস ১৮২৭৫