article

সম্পদ উপার্জন ও ব্যয়ের ইসলামী মূলনীতি

৪ মার্চ, ২০২৩, রাত ১২:০০

শায়খ আহমাদুল্লাহ

শায়খ আহমাদুল্লাহ

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে মানুষকে জীবনের সকল বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান করে। সম্পদ মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এর মাধ্যমেই মানুষের জীবন আবর্তিত হয়। এক্ষেত্রে ইসলাম বিস্তারিত দিকনির্দেশ প্রদান করেছে। এই আলোচনায় এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। এখানে আমরা সম্পদের উপার্জন ও ব্যয় সম্পর্কিত কয়েকটি মূলনীতি সম্পর্কে আলোচনা করব। যা মেনে চলা এবং মনে-প্রাণে ধারণ করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আবশ্যক।

১. সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হলো— এই বিশ্বাস পোষণ করা ও মনে-প্রাণে ধারণ করা যে, সকল সম্পদের মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। আমরা আল্লাহর গোলাম, দাস ও বান্দা হিসেবে বৈধ বা অবৈধ উপায়ে যতটুকু সম্পদ আহরণ ও সঞ্চয় করি, এগুলোর মূল মালিকানা আমাদের কারোরই নয়। কারণ আমরা সম্পদকে যতভাবে ব্যবহারোপযোগী করি, এর মূলে গেলে দেখা যাবে তা মৌলিকভাবে আল্লাহ-প্রদত্ত। উদাহরণস্বরূপ: আপনি কাঠ দিয়ে অনেক কিছু তৈরি করেছেন। এটিকে আপনি বিভিন্নভাবে ব্যবহারোপযোগী করলেও কাঠ মূলত আল্লাহর দেওয়া। তদ্রূপ প্রতিটি মৌলিক পদার্থ আল্লাহর দান।

কুরআন কারীমে আল্লাহ তাআলা এ বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে বুঝিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন— আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, সব আল্লাহর।[1]

বাহ্যত আমাদের হাতে উপার্জিত সব সম্পদ মূলত আমাদের কাছে আল্লাহর আমানত।

প্রত্যেক মুসলিমকে এই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে হবে। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক কল্যাণ নিহিত আছে। অন্যতম কল্যাণ হলো— অহঙ্কার বিদূরিত হয়। যিনি এই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে পারেন এবং মনে-প্রাণে এই দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করতে পারেন, তাঁর মধ্যে দম্ভ ও অহঙ্কার থাকে না। থাকলেও ক্রমে দূর হয়ে যায়। দুনিয়াতে যত অশান্তি, অনাচার ও ফাসাদ হয় এর অনেক কারণের মধ্যে অহঙ্কার অন্যতম। যখন মানুষ কোনো একটা দিক থেকে এগিয়ে যায়, তখন তার মধ্যে অহঙ্কার ও দম্ভ আসে। দাম্ভিকতা ও অহঙ্কারের কারণে মানবসমাজে যুগ যুগ ধরে শান্তি বিঘ্নত হচ্ছে। পক্ষান্তরে যখন মানুষ এই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করবে যে, আমার উপার্জিত সকল সম্পদ মূলত আল্লাহর, আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, কত দিন থাকবে আমি নিজেও জানি না— তখন আর মনে অহঙ্কার স্থান করে নেওয়ার সুযোগ পাবে না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে অহঙ্কার বিদূরিত হয়ে যাবে। কারণ যে সম্পদই আমার নয়, সেই সম্পদের জন্য অহঙ্কার করার সুযোগ নেই। ফলে অহঙ্কারপ্রসূত সকল ফাসাদ দূর হয়ে যাবে। পৃথিবী শান্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।

যার হাজার কোটি টাকা আছে, সে আরো সম্পদ উপার্জন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। তার ভোগ-বিলাসের কোনো কিছুর অভাব নেই, অভাব হওয়ার কারণও নেই। তবু সম্পদ অর্জনের জন্য এত চেষ্টা করার কারণও দম্ভ। আর্থিকভাবে তাকে কেউ অতিক্রম করে যাবে, এটি মানবনম মানতে চায় না। এতে তার দম্ভ-অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যায়, এটা সে মানতে পারে না।

ঈমানদার যখন মনে-প্রাণে বিশ্বাস করবে যে, সকল সম্পদ আল্লাহর দেওয়া, তখন সে বিনয়ী হবে; অহঙ্কারী হবে না। আরেকজন তারচেয়ে আর্থিকভাবে এগিয়ে গেলে তার দম্ভ চূর্ণ হওয়ার অপমান বোধ করবে না। ফলে সে আরো সম্পদ উপার্জনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে না।

২. ইসলাম সম্পদ উপার্জনের পদ্ধতি বেঁধে দিয়েছে: সম্পদ উপার্জন করতে শরীয়াহ নিষেধ করে না। বরং ঘরে বসে না থেকে উপার্জন করতে আদেশ করে। আল্লাহ বলেন— সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে ও আল্লাহকে অধিক পরিমাণ স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলকাম হও।[2]

ইসলাম মানুষকে গরিব হয়ে থাকতে বলে না। বিখ্যাত সাহাবী উসমান (রা.) বিত্তবান মানুষ ছিলেন। ইসলাম সম্পদ উপার্জনের কথা বললেও সম্পদ উপার্জনের পদ্ধতি সম্পর্কে বিধি-নিষেধ আরোপ করে। বিধিসম্মত পদ্ধিতেতে সম্পদ উপার্জন করতে আদেশ করে, বিধিবহির্ভূত পদ্ধতিতে উপার্জন করতে নিষেধ করে।

৩. সম্পদ ক্ষণস্থায়ী: প্রত্যেক মুমিনকে এই বিশ্বাস লালন করতে হবে যে, সম্পদ ক্ষণস্থায়ী। আল্লাহ আমাদেরকে সম্পদ দিয়েছেন। আবার তিনি কখন সম্পদ নিয়ে যাবেন, একমাত্র তিনিই জানেন। দুনিয়াতে এমন কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়নি, যা নিশ্চয়তা দিতে পারে, সম্পদ নষ্ট হবে না, চিরস্থায়ী হবে। এজন্যই আমরা দেখতে পাই— কয়েকদিন আগেও যিনি অঢেল সম্পদের মালিক ছিলেন, তিনি এখন পথের ফকির। এর উল্টো উদাহরণও অনেক। একজন ফকির ছিলেন, তিনি এখন ধনী হয়ে গেছেন। কাজেই ক্ষণস্থায়ী সম্পদ নিয়ে দম্ভ প্রদর্শন করা সমীচীন নয়।

৪. আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় সম্পদ ব্যয় করতে হবে: আল্লাহ যেমন সম্পদ দিয়েছেন, তেমনি আল্লাহ সম্পদ ব্যয়ের গাইডলাইনও দিয়েছেন। সম্পদ উপার্জন যেমন আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় করতে হবে, তেমনি আল্লাহর নির্দেশিত পথে খরচ করতে হবে। কারণ সম্পদের প্রকৃত মালিক আমরা নই। এর প্রকৃত মালিক আল্লাহ। সম্পদের মালিক যেভাবে খরচ করার আদেশ করেন, সেভাবেই খরচ করতে হবে। এর ব্যতিক্রম করার সুযোগ নেই।

৫. আমাদের সম্পদে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও গরিব প্রতিবেশীর হক রয়েছে: হাদীসের আলোকে জানা যায়, আমাদের সম্পদ আমাদের একার নয়। আমাদের সম্পদে আমাদের পরিবার, গরিব আত্মীয়-স্বজন ও গরিব প্রতিবেশীর হক রয়েছে। কেউ হয়ত উপার্জন-অক্ষম প্রতিবন্ধী, শিশু, গরিব— আমাদের সম্পদে তাদের অংশও রয়েছে। তাদের রিযিকও আল্লাহ আমাদের সম্পদের মধ্যে দিয়ে দিয়েছেন। কাজেই আমাদের উচিত তাদেরকে নির্দিষ্ট অংশ দেওয়া। আপনার উপার্জিত সম্পদ পুরোটা নিজের মনে করে কাউকে দেওয়া অপ্রয়োজনীয় মনে করা দৃষ্টিভঙ্গিগতভাবে বড় ধরনের ত্রুটি।

তবে এ কথা তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে না, যারা উপার্জনক্ষম হওয়া সত্ত্বেও কিছুই করে না। আত্মীয়-স্বজনদের কেউ বিত্তবান হলে তারা কাজ করতে চায় না। বিত্তবানের প্রতি চেয়ে থাকে। এটা এসব গরিব আত্মীয়-স্বজনের চিন্তাগত ত্রুটি। তাদেরকে এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

৬. সম্পদ সম্পর্কে আমরা জিজ্ঞাসিত হব: প্রত্যেক মুসলিমকে এই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে হবে যে, কিয়ামতের দিন আমরা উপর্জিত ও ব্যয়ীত সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হব। নবী কারীম (সা.) বলেছেন— কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দেওয়া ব্যতীত কোনো বান্দা (কিয়ামতের দিন) দু’ পা অগ্রসর করতে পারবে না— তার জীবনকাল সম্পর্কে, সে তা কীভাবে কাটিয়েছে; তাঁর অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী কী আমল করেছে; তার সম্পদ কীভাবে উপার্জন করেছে এবং কোথায় খরচ করেছে; তার শরীর কীভাবে বিনাশ করেছে।[3]

কাজেই আমাদের উপার্জন-প্রক্রিয়া যেমন বৈধ হতে হবে, তেমনি বৈধ পথে খরচ করতে হবে। তা না হলে কিয়ামতের দিন আমাদেরকে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হবে। সদুত্তর দিতে না পারলে এক পাও অগ্রসর হতে পারব না।

ভোগবাদী দুনিয়া বলে— যার সম্পদ সে খরচ করবে, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে খরচ করবে, যেখানে খুশি সেখানে খরচ করবে। পক্ষান্তরে ইসলাম বলে— যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে উপার্জন এবং ব্যয় করা যাবে না। উপার্জন ও ব্যয়ের মূলনীতি পুরোপুরি মান্য করতে হবে। এতেই রয়েছে ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ।

ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, আমাদেরকে গাইডলাইন মেনে চলতে হয়। পৃথিবীর যে কোনো দেশে ও সমাজে আমরা বাস করি, আমরা সেই দেশ ও সমাজের আর্থিক নীতিমালা মেনে চলতে বাধ্য। সে দেশ ও সমাজের নীতিমালা লঙ্ঘন করার সুযোগ আমাদের নেই। তেমনি আমাদেরকে এই ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান মেনে চলতে হবে। বরং দেশ ও সমাজের ওপর আল্লাহর বিধানকে স্থান দিতে হবে। আমার সম্পদ আমি যেভাবে ইচ্ছা খরচ করব, কোনো মুসলিম এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে পারে না।

৭. সম্পদ ভোগ-উপভোগের পদ্ধতি অসীম নয়: ইসলামের দর্শন হলো— আল্লাহ আমাদেরকে সম্পদ দিয়েছেন আমাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য, যাচ্ছেতাই পন্থায় ভোগের জন্য নয়। জীবনের প্রাত্যহিক ব্যয় নির্বাহ করার পাশাপাশি আমরা সম্পদ ভোগ করব, তবে তার পন্থা ও পদ্ধতি অসীম নয়। এর নির্ধারিত সীমা আছে। কারণ ঈমানদারের বিশ্বাস— দুনিয়াই শেষ নয়, এরপরে রয়েছে আখিরাতের অসীম জীবন। এক্ষেত্রে একজন আখিরাতে বিশ্বাসী মানুষের দর্শন ও আখিরাতে অবশ্বাসীর দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। আখিরাতে অবিশ্বাসীর কাছে দুনিয়াটাই সব। এজন্য সে দুনিয়াটাকে ভোগের বিষয় মনে করে, যাচ্ছেতাইভাবে খরচ করে, সম্পদের মালিক হলে ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকে। পক্ষান্তরে একজন মুমিনের বিশ্বাস হলো— দুনিয়া খুবই ক্ষণস্থায়ী। মৃত্যুর পরে রয়েছে অসীম জীবন। ফলে সে অসীম ও অনন্ত জীবনের কথা মাথায় রেখে জীবন যাপন করে। দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে ডুবে যায় না। সে আল্লাহ ও রাসূল (সা.) কর্তৃক নির্ধারিত সীমা মেনে প্রয়োজনীয় খরচ করে ও পরিমিত ভোগ করে।

দুঃখজনকভাবে আখিরাতের প্রতি আমাদের ঈমান দুর্বল হওয়ার কারণে মুসলিম হয়েও আমরা অসৎ হই। যাচ্ছেতাইভাবে সম্পদ উপার্জন করি, যাচ্ছেতাইভাবেই খরচ করি।

৮. অপচয় করা যাবে না: এটাও মুমিনের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পালনীয় বিষয়। সম্পদ থাকলেই অপচয় করার সুযোগ নেই। আল্লাহ অপচয় করা পছন্দ করেন না। কুরআনে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের তালিকা বলেছেন। এর মধ্যে এক শ্রেণি হলো, যারা অপচয় করে না।[4]

সা’দ (রা.) ওযু করছিলেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, ‘সা’দ অপচয় করছ কেন?’ সা’দ বললেন, ‘ওযুতেও কি অপচয় হয়?’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, নদীতে ওযু করলেও।’[5]

পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ যদি অপচয় করা বন্ধ করে দেয়, তাহলে বাকি অর্ধেক মানুষের খাদ্যসংকট মিটে যাবে। পৃথিবীতে এক ধরনের অসম ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। এক দিকে কেউ অপচয় করছে আরেক দিকে কেউ খেতেও পারছে না। অপচয় রোধ করে যথাস্থানে খরচ করলে সাম্যাবস্থা তৈরি হবে।

৯. কৃপণতা করা যাবে না: ইসলাম অপচয় ও অপব্যয় করতে যেমন নিষেধ করে, তেমনি কৃপণতা করতেও বারণ করে। কৃপণতা মানে— প্রয়োজনীয় খরচও না করা, দান-সদকা না করা। আমাদের নবীজি আমাদেরকে মধ্যমপন্থা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি কৃপণতা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতেন।[6] কাজেই প্রত্যেক মুমিনকে অপচয় ও কৃপণতার মাঝামাঝি থাকতে হবে।

ইসলাম আমাদেরকে সম্পদ উপার্জন ও সম্পদ ব্যয়ের যে নীতিমালা দান করেছে, তা আমাদেরকে মনে-প্রাণে ধারণ করতে হবে এবং প্রাত্যহিক জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের সন্তানদেরকে উপরে বর্ণিত মূলনীতি শিক্ষা দিতে হবে এবং তদনুযায়ী তাদের জীবন পরিচালনা করতে উৎসাহিত করতে হবে। আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দিন।

 

[1] সূরা বাকারা, আয়াত ২৮৪

[2] সূরা জুমুআ, আয়াত ১০

[3] সুনান তিরমিযী-২৪১৭

[4] সূরা ফুরকান, আয়াত ৬৭

[5] মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭০৬৫

[6] সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭২২