article

মানবিক ও সুস্থ ধারার সমাজ গঠনে মসজিদের ভূমিকা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

২৩ জানুয়ারী, ২০২৩, রাত ১২:০০

শায়খ আহমাদুল্লাহ

শায়খ আহমাদুল্লাহ

মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুর নাম মসজিদ। মসজিদ ছাড়া মুসলিম সমাজ কল্পনা করা যায় না। মসজিদ শিআরে ইসলাম তথা ইসলামের নিদর্শনাবলির অন্তর্ভুক্ত। কোনো অঞ্চলে মসজিদ থাকার অর্থ হলো সেখানে মুসলমানদের অস্তিত্ব আছে। মসজিদকে আদর্শ ইসলামী সমাজের হৃৎপিণ্ডও বলা যায়। আল্লাহ তায়ালার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় স্থান মসজিদ। মদিনায় হিজরতের পর রসুলুল্লাহ সা. এর ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো মসজিদ থেকে। রসুলুল্লাহর সা. পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন পরবর্তী খলীফাগণ। ইসলামের প্রথম যুগের মসজিদের দিকে যদি আমরা দৃষ্টিপাত করি, দেখতে পাব, সেই সময়ের মসজিদ শুধু নামাযের ঘর ছিল না; বরং তাদের মসজিদ ছিল পরামর্শগৃহ, বিচারালয়, শিক্ষাকেন্দ্র, মজলুমের আশ্রয়স্থল, শিশুদের আনন্দধাম। রাসূলের সা. মসজিদ ছিল সৌরজগতের সূর্যের মতো; সূর্যকে কেন্দ্র যেমন আবর্তিত হয় সকল গ্রহ-উপগ্রহ; তেমনি মুসলমানদের আধ্যাত্মিক, মানবিক ও সামাজিক সকল কর্মকাণ্ড আবর্তিত হতো মসজিদকে ঘিরে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, কালের পরিক্রমায়, বিশেষত বাংলাদেশে, মসজিদ হয়ে গেছে শুধুই নামাযের স্থান। মুসলমানদের চরিত্র গঠন, দীনি শিক্ষা, আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও মানবিক কর্মসূচীতে মসজিদের কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে।

ইসলামে মসজিদের গুরুত্ব: মসজিদ পৃথিবীর আদি নিদর্শন। আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে সবার আগে মসজিদ সৃষ্টি করেছেন। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয় প্রথম ঘর, যা মানুষের জন্য স্থাপন করা হয়েছে, তা মক্কায় অবস্থিত। যা বরকতময় ও হিদায়াত বিশ্ববাসীর জন্য [আলে ইমরান ৯৬]। রসুলুল্লাহ সা. যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলেন, মদিনার উপকণ্ঠে কুবা পল্লীতে তিনি সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করলেন। মসজিদে কুবা ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মসজিদ হাওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। এরপর তিনি যখন মদিনা নগরীতে প্রবেশ করলেন, সাহাবিদের সঙ্গে নিয়ে তিনি মদিনার কেন্দ্রবিন্দুতে নির্মাণ করলেন মসজিদ। তখন মুহাজির সাহাবিদের কোনো ধনসম্পদ ছিল না। সকল সহায়-সম্পত্তি মক্কায় রেখে তারা এক কাপড়ে ঘর ছেড়েছিলেন। এই রকম সংকটময় মুহূর্তেও রাসূল সা. মসজিদের জন্য জমি ক্রয় করে এর অবকাঠানো তৈরি করলেন। মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে রাসূল সা. শুধু আদেশ করেই ক্ষান্ত হননি, হাদীস ও ইতিহাস সাক্ষী, সাহাবিদের সাথে তিনি নিজ হাতে কাদামাটির ইট বানিয়েছেন, সেই ইট কাঁধে বহন করেছেন। রাসূলের কাছে মসজিদের নির্মাণ কাজও এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

তিনি যে মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ, বারবার তার নজির স্থাপন করেছেন। শুধু তাই নয়, যারা মসজিদ নির্মাণ করে, তাদের জন্য সুসংবাদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য মসজিদ নির্মাণ করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ ঘর বানাবেন। [বুখারী ও মুসলিম]

অন্যত্র রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যেদিন আল্লাহর আরশের ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত শ্রেণির মানুষ আল্লাহর ছায়ায় আশ্রয় পাবে। সাত শ্রেণির এক শ্রেণি হলো ওই সকল মানুষ, যাদের হৃদয় সব সময় মসজিদের সাথে যুক্ত থাকে। [বুখারী ও মুসলিম]

আদর্শ সমাজ গঠনে মসজিদের ভূমিকা: আদর্শ ও মানবিক সমাজ গঠনে মসজিদের ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসু, তার সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা আমরা রাসূলের সা. যুগের মসজিদে নববি থেকে পাই। সকল প্রকার ধর্মীয়, মানবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে এই মসজিদ থেকে। মসজিদভিত্তিক সমাজব্যস্থার মাধ্যমে অগ্নিগহ্বরের কিনারায় অবস্থিত একটি জাতিকে রাসূল সা. সোনার মানুষে পরিণত করেছেন।

একত্ববাদের চেতনা তৈরি: মসজিদ তাওহিদের প্রতীক। মসজিদে রাসূলের তরিকায় এক আল্লাহর ইবাদত করা হয়। মসজিদের ইমাম-খতিব যদি বিজ্ঞ ও হকপন্থী আলেম হন এবং ওই সমাজ যদি মসজিদ দ্বারা পরিচালিত হয়, তবে মুসল্লিদের ভেতর থেকে আপনাআপনি শিরিক বা বহুত্ববাদী চেতনা দূর হয়ে যায়। রসুলুল্লাহ সা. জুমআর বয়ানে, সাধারণ আলোচনায়, ব্যক্তিগত নসিহতে বারবার শিরিকের ব্যাপারে মুসল্লিদেরকে সতর্ক করতেন। যার ফলে এক সময়ের মূর্তিপূজারী মানুষগুলো শিরিক বর্জন করে তাওহিদের রশিকে শক্ত করে আকড়ে ধরে। কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী একজন ইমাম যখন মসজিদে নববির আদলে তার মুসল্লিদেরকে তাওহিদের দীক্ষা দেন এবং শিরিকমুক্ত ঈমান গঠনের নাসিহাহ পেশ করেন, তখন সেই সমাজ খুব সহজেই তাওহিদি সমাজে পরিণত হয়।

ভ্রাতৃত্ববোধ: ইসলাম যে কয়টি বিধানের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে, তারমধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মুসলমানদের পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ববোধ স্থাপন। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, প্রকৃত মুসলমান সে, যার হাত এবং মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। [বুখারী ও মুসলিম] মসজিদভিত্তিক সমাজব্যবস্থা মুসলমানদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও সুসম্পর্ক তৈরিতে জোরালো ভূমিকা রাখে। মসজিদভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় মানুষেরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে আদায় করে। নামাযের কাতারে ইসলাম ধনী-গরিব, আমীর-ফকিরের কোনো বৈষম্য রাখেনি। ফলে প্রতিটি মানুষ তার পেশা, বংশ ও অর্থনৈতিক তারতম্য পেছনে ফেলে নামাযের কাতারে এক ও অভিন্ন মর্যাদার মানুষে পরিণত হয়। এতে সুদৃঢ় হয় পারস্পরিক সম্পর্ক এবং নির্মূল হয় উঁচুনিচুর ভেদাভেদ। তাছাড়া নিয়মিত জামাতে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে প্রত্যেকে তার মুসলমান ভাইয়ের অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকে। অসুস্থতা অথবা অন্য কোনো বিপদে কেউ নামাযে অনুপস্থিত থাকলে বাকিরা সহজেই তার খোঁজখবর এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে পারে। আবার সালাতের মাধ্যমে প্রতিদিন দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ায় সম্প্রীতি ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। এভাবে মসজিদভিত্তিক সমাজব্যবস্থা পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও ভালোবাসায় একটি জাতিকে একই সুতোয় গাথা একটি তসবিহতে পরিণত করে।

নেতৃত্ব আনুগত্যের অনুশীলন: ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, যিনি নামাযের ইমাম তিনি সমাজেরও ইমাম। একজন ইমাম যখন মসজিদ পারিচালনা করেন, সালাতের নেতৃত্ব দেন, মুসল্লিদের নাসিহাহ করেন, তার মধ্যে সামাজিক নেতৃত্বের স্বতঃস্ফূর্ত যোগ্যতা তৈরি হয়। ধীরে ধীরে সমাজের জন্য তিনি প্রোডাক্টিভ নেতায় পনিণত হন। আবার মুসল্লিবৃন্দ, যারা নামাযে ইমামের হুবহু অনুসরণ করেন, তাদের মধ্যে নেতাকে মান্য করারে মানসিকতা এবং আনুগত্যের বোধ জাগ্রত হয়। ফলে সেই সমাজের মানুষেরা, মসজিদভিত্তিক জীবনব্যবস্থা অনুশীলনের কারণে, সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত হয়।

জ্ঞানচর্চার সূতিকাগার: রাসূলের যুগের মসজিদে নববি ছিল কুরআন ও হাদীস চর্চার দরসগাহ। আসহাবে সুফফার কথা আমরা জানি। একদল দরিদ্র সাহাবি, ইলমচর্চার জন্য তারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের কোনো পেশা ছিল না। মসজিদে নববিতে পড়ে থাকতেন। কোনো খাবার হাদিয়া এলে খেতেন না এলে উপোস থাকতেন। তারা রাসূলের সা. মুখনিঃসৃত হাদীস সংরক্ষণ ও প্রচার করতেন। এছাড়া রাসূল সা. যখনই সুযোগ পেতেন, মসজিদে এসে সাহাবিদেরকে কুরআন ও হাদীস শেখাতেন।

মসজিদ যেন ইলমচর্চার মারকায হয়ে ওঠে, এ ব্যাপারে রাসূল সা. সাহাবিদেরকে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি মসজিদে ইলমচর্চার সুসংবাদ প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন, কোনো সম্প্রদায় যখন আল্লাহর ঘরে একত্রিত হয়ে কুরআন তেলাওয়াত ও পরস্পরে জ্ঞানচর্চা করে, তাদের ওপর শান্তি নাযিল হয়, আল্লাহর রহমত তাদেরকে পরিবেষ্টন করে এবং ফেরেশতারা তাদেরকে ঘিরে রাখেন; মহান আল্লাহ উপস্থিত ফেরেশতাদের কাছে জ্ঞানচর্চাকারীদের কথা আলোচনা করেন। [মুসলিম]

মসজিদভিত্তিক মক্তব আমাদের সোনালি অতীত। মক্তব বাদ দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। অথচ অত্যন্ত সুকৌশলে এই অপূর্ব কুরআনিক শিক্ষাব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। মসজিদভিত্তিক দীনি জ্ঞানচর্চার ধারা জারি থাকলে মানুষেরা খুব সহজেই ইসলামের মৌলিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে পারে। আর কোনো সমাজে ইসলামী জ্ঞানে জ্ঞানবান মানুষেরা সংখ্যা যত বাড়ে, সেই সমাজ ততবেশি অপরাধ, দুর্নীতি, হত্যা, অশ্লীলতা, ধর্ষণ, যৌতুক ও মাদকমুক্ত সোনার সমাজে পরিণত হয়। অতীতের মক্তবভিত্তিক কুরআনিক শিক্ষাব্যবস্থা তার পরীক্ষিত উদাহরণ। এছাড়া মসজিদভিত্তিক পাঠাগারের সংস্কৃতি চালু থাকলে মুসল্লিরা নামাযের পাশাপাশি কুরআন হাদীসসহ জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সমৃদ্ধ হতে পারে। যে সমাজে মসজিদভিত্তিক জ্ঞানচর্চার সংস্কৃতি যত জোরালো হবে, সেই সমাজ ততবেশি মানবিক, সুস্থ ও আদর্শ সমাজে রূপান্তরিত হবে।

পারিবারিক সংকট নিরসন: রাসূল সা. সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন পরিবার-ব্যবস্থাকে। পারিবার রিলেটেড যত হাদীস আছে, অন্য কোনো বিষয়ে সম্ভবত এত হাদীস বর্ণিত হয়নি। কারণ—পরিবার হলো সভ্যতার সূতিকাগার। পরিবার ধ্বংস হলে সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। রাসূল সা. মসজিদে বসে সাহাবিদের পারিবারিক সমস্যার সমাধান দিতেন। কখনো স্বামী-স্ত্রীকে উপস্থিত করে কাউন্সেলিং করতেন। একটি আদর্শ মসজিদের বৈশিষ্ট্য এটাও যে, সেখানে পারিবারিক সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। কর্তৃপক্ষের উচিত—মসজিদে এমন ব্যবস্থা রাখা, যেন সমস্যাগ্রস্ত মানুষেরা সহজেই তাদের সমাধান পেয়ে যায়।

পরামর্শগৃহ: নামাযের পাশাপাশি রাসূলের সা. মসজিদ পরামর্শ সভার জন্য ব্যবহৃত হতো। হদ, জিহাদ, চুক্তি, কূটনৈতিক সম্পর্ক, পররাষ্ট্রনীতি সহ সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো মসজিদে নববিতে, পরামর্শের ভিত্তিতে। সেই অর্থে মসজিদে নববি ছিল পরামর্শগৃহও। রাসূলের সা. পর খোলাফায়ে রাশেদার যুগেও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত মসজিদে নববিতে নেয়া হতো। একটি সুস্থ ও মানবিক সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে মসজিদভিত্তিক পরমর্শসভার বিকল্প নেই। পরামর্শের জন্য মসজিদের বরকত তো আছেই, পাশপাশি দায়িত্বশীলরা যখন পরামর্শ করতে মসজিদে একত্রিত হন, তখন কাজটার প্রতি তাদের গুরুত্ব বেড়ে যায় ও সম্ভ্রমবোধ জাগ্রত হয়।

মসজিদকেন্দ্রীক আইন বিচারব্যবস্থা: নামাযের পাশাপাশি রাসূলের সা. মসজিদ সালিশ-বিচারের জন্যও ব্যবহৃত হতো। নববি যুগ, খোলাফায়ে রাশেদার যুগ সহ ইসলামের সোনালি দিনের মুসলিম সমাজের বিচার ব্যবস্থা ছিল মসজিদকেন্দ্রীক। মসজিদভিত্তিক বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে রাসূল সা. সমাজ থেকে সকল প্রকার অপরাধের মূলোৎপাটন করেছিলেন। এখনো কোনো সমাজে যদি মসজিদভিত্তিক বিচারব্যবস্থার সংস্কৃতি চালু থাকে, তবে সেই সমাজ নববি আমলের সুফল পেতে পারে। মিথ্যা মামলা, মিথ্যা সাক্ষ্য, ঘুষ খেয়ে বিচারক কর্তৃক নিরপরাধকে ফাঁসিয়ে দেয়ার মতো জঘন্য পাপ ও অন্যায় চালু আছে দুনিয়া জুড়ে। যার কারণে মানুষ ইনসাফ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মসজিদভিত্তিক বিচারব্যবস্থা চালু থাকলে এই অপকর্ম রোধ করা সম্ভব। কারণ, মসজিদের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও ভীতি নেই, এমন মুসলমানের সংখ্যা খুবই কম। মসজিদে দাঁড়িয়ে ভুল বিচার বা মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করতে গেলে যে কেউই দশবার ভাববে। অতএব মসজিদকেন্দ্রীক বিচারব্যবস্থা চালু হলে আখেরে জনগণেরই কল্যাণ হবে এবং এর মাধ্যমে নিশ্চিত হবে ইনসাফ।

মসজিদের অর্থনৈতিক ভূমিকা: সমাজ পরিবর্তনের জন্য মসজিদগুলোকে ধর্মীয় দায়িত্বের পাশাপাশি অর্থনীতির ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে হবে। মানুষের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-বেদনার ভাগিদার হতে হবে মসজিদ কর্তৃপক্ষকে। রাসূল সা. যুদ্ধলব্ধ গনিমতের মালামাল বণ্টন করতেন মসজিদ প্রাঙ্গনে। আবার যাকাতের মাল গ্রহণ ও বিতরণ করতেন মসজিদে নববির ভেতর। মসজিদে শিক্ষাদান অথবা নাসিহাহ করার সময় কখনো রাসূলের সা. কাছে খাদ্যদ্রব্য হাদিয়া এলে রাসূল সা. মসজিদে বসে সেই খাদ্যদ্রব্য সাহাবিদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন। মসজিদে কোনো ক্ষুধার্ত আগন্তুক এলে রাসূল সা. তাকে বাড়িতে নিয়ে যেতেন অথবা কোনো সাহাবির বাড়িতে পাঠাতেন। জনগণের প্রতি যে মসজিদের এবং মসজিদ কর্তৃপক্ষের অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্বও আছে, তার প্রমাণ আমরা এসব ঘটনা থেকে পাই।

তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকদের কাছে ক্ষুধা এক রূঢ় সত্যের নাম। তীব্র ক্ষুধা ও অভাবের কারণে অনেক মানুষ ঈমান পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। গ্রামাঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত অসংখ্য মানুষ সালাত আদায় না করার পেছনে অভাবকে দায়ী করে। আবার অভাবের কারণে এদেশের পাহাড়ি ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলের অসংখ্য মানুষের খ্রিষ্টান হয়ে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনার নাম। রাসূল সা. জানতেন যে দরিদ্রতা কখনো কখনো ঈমান নষ্ট করে দিতে পারে। এ জন্য তিনি দুআ করতেন, হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে কুফুরি ও ফকিরি থেকে পানাহ চাই।

বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে মসজিদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু করা খুবই জরুরি। মসজিদ কর্তৃপক্ষ চাইলে যাকাত-ফিতরা আদায় করে দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করতে পারে। আবার ফান্ড তৈরি করে অভাবীদের কাছে খাদ্যদ্রব্য ও চিকিৎসেবা পৌঁছতে পারে।

স্বাবলম্বীকরণ, অভাব দূরীকরণ, বিনামূল্যে খাদ্যবণ্টন, চিকিৎসা সহায়তা প্রদান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মসজিদকে সম্পৃক্ত হতে হবে, যেভাবে সম্পৃক্ত ছিল রাসূলের সা. মসজিদ। তবেই মসজিদভিত্তিক সুস্থ ও মানবিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

সমাজ-সম্পৃক্ত মসজিদ নির্মাণে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের স্বপ্ন পরিকল্পনা: আল্লাহর শোকর, প্রতিষ্ঠার শুরুলগ্ন থেকেই আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন দীনি ও জনসম্পৃক্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় মসজিদে নববির আদলে দীনি চেতনা সমৃদ্ধ, সমাজ-সম্পৃক্ত, কল্যাণমুখী একটি মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণের দিকে আমরা ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছি, আলহামদুলিল্লাহ। আমরা সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী। আমরা মসজিদভিত্তিক আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষী। সালাত আদায়ের পাশাপাশি রাসূলের সা. মসজিদে যেসব কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হতো, আমরা আমাদের মসজিদ কমপ্লেক্সে সেসব কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে চাই।

মসজিদ-ভিত্তিক দীনি শিক্ষা-ব্যবস্থা: আস-সুন্নাহ মসজিদ কমপ্লেক্সে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের জন্য পৃথক সালাত আদায় ও দীনি শিক্ষা-ব্যবস্থার পরিকল্পনা আছে। এখাসে থাকবে শিশুদের জন্য প্লে গ্রাউন্ড, যেন তারা মসজিদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। মসজিদের একপাশে অমুসলিমদের কর্নার থাকবে; যেন তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে খুতবা শ্রবণসহ ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে।

দীনি জেনারেল শিক্ষার সমন্বয়ে আধুনিক মাদরাসা: এই মাদরাসায় নারী ও পুরুষের জন্য পৃথকভাবে দীনি ও সাধারণ শিক্ষার সমন্বিত সিলেবাসের পাঠপ্রদান করা হবে। সাধারণ সিলেবাসের সাথে দশম শ্রেণির মধ্যে ধাপে ধাপে হিফয সম্পন্ন করানো হবে। যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যোগ্য আলেম গড়ে তোলা এই মাদরাসার লক্ষ্য।

শরয়ী সমাধান: এই বিভাগে সরাসরি বিজ্ঞ আলেম ও প্রশিক্ষিত মুফতীগণের সঙ্গে সাক্ষাত করে দীনি সমস্যার সমাধান জানা যাবে।

উচ্চতর ইসলামী গবেষণাকেন্দ্র: জ্যেষ্ঠ ইসলামিক স্কলারদের তত্ত্বাবধানে নবীন মেধাবী আলেমদেরকে দুই-তিন বছরের কোর্সের মাধ্যমে যুগচ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যোগ্য করে গড়ে তোলা এই কেন্দ্রের প্রধান লক্ষ্য। তাদেরকে সমাজ-বিজ্ঞানসহ দাওয়াহর ময়দানে প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহের ধারণা দেওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া এই কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন দীনি বিষয়ে গবেষণা করা হবে।

বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবাকেন্দ্র: গরিব-অসহায় রোগীদেরকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাধ্যমে বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা-সহায়তা প্রদান করা হবে। ক্ষেত্রবিশেষ ওষুধ ও উন্নত চিকিৎসার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

ফ্যামিলি কাউন্সেলিং বিভাগ: দাম্পত্য-কলহ নিরসনকল্পে ও পারিবারিক ব্যবস্থা আরো সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে এই বিভাগ কাজ করবে। সমাজতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞ আলেমদের মাধ্যমে বিবাহেচ্ছু ও বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।

সমাজকল্যাণ পরিচালনা বিভাগ: এই বিভাগ থেকে মানব-কল্যাণে নানা সেবামূলক উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। স্বাবলম্বীকরণমূলক নানা কার্যক্রম, অদক্ষ জনগোষ্ঠীকে কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ, এতিম ও বিধবাদের দায়িত্বগ্রহণ এবং সেবামূলক নানা কার্যক্রম এই বিভাগ থেকে পরিচালিত হবে ইন-শা-আল্লাহ।

পাবলিক লাইব্রেরি: সর্বসাধারণকে দীনি ও উপকারী বই-পুস্তক পড়তে উৎসাহিত করার জন্যে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত বৃহৎ পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হবে ইন-শা-আল্লাহ।

শিশু-কিশোরদের জন্য ইসলামী সংস্কৃতিকেন্দ্র: শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য সুস্থ বিনোদনচর্চা অপরিহার্য। অথচ আজকাল শিশুরা অনেকটাই অবহেলিত। শিশু-কিশোরদের সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা এই কেন্দ্রের মূল উদ্দেশ্য। এখান থেকে সংস্কৃতিচর্চার পাশাপাশি ইসলামের মৌলিক আকীদা ও বিধানাবলি শিক্ষাদান করা হবে।

মসজিদ মুসলিম সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। রাসূল সা. ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম পরিচালক। সেই অর্থে মসজিদ আমাদের জন্য রাসূলের সা. রেখে যাওয়া আমানত। এই আমানতের সুরক্ষা এবং এর সঠিক ব্যবহার আমাদের ওপর ফরজ দায়িত্ব। মসজিদভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাসূল সা. একটা পৃথিবীর পট পরিবর্তন করেছিলেন। পতোন্মুখ এই মুসলিম জাতিকে রক্ষা করতে মসজিদভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের কোনো বিকল্প নেই।